ডিএসসিসির নামে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব

চাঁদাবাজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ট্রাকচালক

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নামে প্রকাশ্যে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। এই চাঁদাবাজি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকবার অভিযানে নামলেও সফলতা মেলেনি। বরং সড়কে চাঁদাবাজি আগের অবস্থায় ফিরেছে। কেউ টাকা না দিতে চাইলে জোর করে নেয়া হচ্ছে। রীতিমতো লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে চাঁদা আদায়। কিন্তু এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। রাজধানীর গুলিস্তান ও শনিরআখড়ায় চাঁদাবাজরা টাকা না পেলেই ট্রাকচালকদের গায়ে হাত তুলছে। কখনো কখনো ট্রাকের গ্লাসও ভেঙে দিচ্ছে। আবার কখনো কখনো ঘটছে জীবনহানির মতো মর্মান্তিক ঘটনাও। এরপরও থেমে নেই চাঁদাবাজি। এ নিয়ে ট্রাকচালক ও মালিকদের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকার প্রবেশদ্বার যাত্রাবাড়ী কাজলা হানিফ ফ্লাইওয়ারের মুখে প্রতিদিন রাত সাড়ে ১১টায় লাঠিসোঁটা নিয়ে দাঁড়ায় একদল যুবক। তারা ডিএসসিসির নামে ট্রাক থেকে জোর করে চাঁদা তুলছে। ট্রাকগুলোকে জোর করে থামিয়ে চালকদের কাছ থেকে ২০০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। অথচ এই ট্রাকগুলো শাকসবজি ও বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। ডিএসসিসির পরিচয়ে ওই যুবকরা ট্রাক আটকে সিটি করপোরেশনের টোল চাইছে। তাদের হাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নামে তিন ধরনের (সাদা, নীল ও গোলাপি) টোল আদায় রশিদ মিলছে। এসব রশিদ দিয়ে ট্রাক প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া যে ট্রাক ১০০ টাকা চাঁদা দেয়, সেই একই ট্রাক চালককে হানিফ ফ্লাইওয়ার পার হলেই কাজলায় গিয়ে আরো ২০০ টাকা চাঁদা গুনতে হচ্ছে। টোল দিতে না চাইলে চালকদের সাথে তর্কে জড়ায়, ট্রাকের লুকিংগ্লাস ভেঙে দেয়। এসব চাঁদাবাজদের হাত থেকে পরিত্রাণ চান ট্রাক চালকরা।

রাত সাড়ে ১২টার দিকে গুলিস্তান ফুলবাড়ীয়া সিটি করপোরেশনের নামে ১০০ টাকা টোল দিয়ে হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর উঠেন ড্রাইভার সুজন মিয়া। তিনি ট্রাক নিয়ে হানিফ ফ্লাইওয়ার পার হতে না হতেই কাজলায় ট্রাকটি ঘিরে ফেলেন একদল যুবক, যাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠিসোটা। ট্রাক ড্রাইভার সুজনের কাছে ২০০ টাকা চাঁদা দাবি করলে সুজন চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে টেনেহিঁচড়ে ট্রাক থেকে নিচে নামানো হয়। পরে যুবকরা বেশ মারধর করে সুজনকে। পরে বাধ্য হয়ে ২০০ টাকা দিয়ে ট্রাক নিয়ে চলে যান। শনিরআখড়া ঢালে গিয়ে সুজন চায়ের দোকানে পানি দিয়ে চোখ ধুচ্ছেন আর বলছেন- এভাবে চাঁদা দিয়ে ট্রাক চালানো কঠিন। সুজন বলেন, আমার কাছ থেকে ২০০ টাকা নিয়েছে, কোনো স্লিপ দেয়নি। সিটি করপোরেশনের নামেই তারা ২০০ বা ৩০০ যার কাছে যেমন পারে টাকা নেয়। ফ্লাইওভারের টোল, পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা ছাড়াও বিভিন্ন টাকা দিতে হয় সড়কে। তাদের টাকা না দিলে ঝামেলা করে, এজন্য বাধ্য হয়ে দিতে হয়। টাকা না দিলে লুকিং গ্লাস ভেঙে দেয়া হয়। দরজায় লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। সেখান থেকে কারওয়ান বাজারে আসার পর গাড়ি থেকে পণ্য নামাতে অপেক্ষারত সময়ের জন্য দিতে হয় ১০০ টাকা। এই টাকার বিপরীতেও কোনো রসিদ দেয়া হয় না।

শনিরআখড়ায় একাধিক ট্রাকচালকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, শনিরআখড়া, চাঁনখারপুল, জয় কালি মন্দির ও রাজধানী সুপার মার্কেটের পাশে এভাবে চাঁদা দিতে হয় নিয়মিত। স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজেশেই এই চাঁদা নেয় তারা। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিবহণ) (যুগ্ম সচিব) মো. হায়দর আলীর সঙ্গে তার দপ্তরে ও মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

রাজধানীর মাতুয়াইল, কাজলা, গুলিস্তান, স্বামীবাগ, টিকাটুলী, কাপ্তানবাজার, দোলাইরপাড়সহ ডিএসসিসি’র বিভিন্ন এলাকায় সিটি টোলের নামে ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের নাম দেয়া রশিদে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘কুলি মজুরি আদায়ের রশিদ’ গুলিস্তান, জয়কালী মন্দির (সায়েদাবাদ সিটি), কাপ্তান বাজার, মতিঝিল, কমলাপুর, যাত্রাবাড়ী, জুড়াইন, কদমতলী, পোস্তগোলা, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, কোনাপাড়া, ডেমরা স্টাফ কোয়াটার, মাতুয়াইল মেডিক্যাল, মেরাদিয়া, নন্দিপাড়া, মাদারটেক, যাত্রাবাড়ী হতে স্টপওভার টার্মিনাল সংশ্লিষ্ট যানবাহন হতে ১০০ টাকা আদায় করতে হবে। এতে ইজাদার হিসেবে ৭-এলেভেন এন্টারপ্রাইজের নাম রয়েছে। আবার ডিএসিসির টোল আদায় রশিদের নামে এসব এলাকায় ট্রাক প্রতি ১০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। তবে পুলিশ ও র‍্যাব এসব এলাকায় চাঁদাবাজির জন্য বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। যাত্রাবাড়ী, পল্টন, ডেমরা, শ্যামপুর, কদমতলী ও ওয়ারী থানায় চাঁদাবাজি মামলা করা হয়েছে। এরপরও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি।

ট্রাকের ড্রাইভার মোজম্মেল হক বলেন, টোল আদায়ের নামে সিটি করপোরেশন চাঁদার লাইসেন্স দিয়েছে। সড়কে ট্রাক থামিয়ে টাকা আদায় করছে। চাঁদা দিতে দেরি হলে মারধর করার হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। ঢাকার মধ্যে ঢুকলেই এসব চাঁদাবাজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ট্রাকচালকরা।

সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশনের আয় বাড়াতে ৭-ইলেভেন এন্টারপ্রাইজকে সিটি টোল আদায়ে ইজারাদা দেয়া হয়েছে। যানবাহনের ধরন এবং কোনো কোনো স্থান থেকে সিটি টোল আদায় করা যাবে, তা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। তবে সেই কার্যাদেশের কোথাও পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান থেকে টোল আদায়ের নির্দেশনা নেই। সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিটি করপোরেশনের টোল আদায়ের কাজও পেয়েছে ৭-ইলেভেন এন্টারপ্রাইজ। টোলের নির্ধারিত হার সিটি বাসের ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৬০ টাকা, টেম্পো, লেগুনা ও পিকআপের ক্ষেত্রে ৩০ টাকা এবং অটোরিকশার ক্ষেত্রে ১০ টাকা। কিন্তু এখানেও টোলের নামে চাঁদা নেয়া হয় ট্রাক থেকে। পরিমাণ সাধারণত ১০০ টাকা। তবে পণ্য বেশি থাকলে বেশি টাকা নেয়া হয়। সড়কে চাঁদাবাজির কারণে গ্রামাঞ্চল থেকে ট্রাক নিয়ে রাজধানীতে আসা শাকসবজি ও বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। চাঁদাবাজদের কারণে পণ্যের বাড়তি দাম ঢাকাবাসীর ওপর গিয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নিয়ম ভঙ্গ করে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে। আমরা এটি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলে আলোচনা করেছি, কোনো সমাধান পাইনি।