মডেল মসজিদ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী

নিত্যপণ্যের সংকট সৃষ্টির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকুন

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে খাদ্যে ভেজাল, মজুতদারি, কালোবাজারি এবং নিত্যপণ্যের সংকট সৃষ্টির অপচেষ্টাকে অত্যন্ত ‘গর্হিত কাজ’ উল্লেখ করে এসবের বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘খাদ্যে ভেজাল দেয়া, মজুতদারি বা কালোবাজারি এবং নিত্যপণ্যের সংকট সৃষ্টি এটা যেন কেউ করতে না পারে সেজন্য সকলকে আমি সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল দেশব্যাপী আরো ৫০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামনে রমজান মাস। এ সময় আমাদের কিছু ব্যবসায়ী জিনিষের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে। এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কারণ, রমজান মাস কৃচ্ছতা সাধনের সময় এবং মানুষ যাতে ভালোভাবে তাদের ধর্মকর্ম এবং রোজা যথাযথভাবে পালন করতে পারে, সেদিকেই সবার দৃষ্টি দেয়া উচিত। এ সময় এসব মুনাফা লোভীদের জিনিষের দাম বাড়ানো আর মানুষকে বিপদে ফেলার কোনো মানে হয় না।

শেখ হাসিনা বলেন, ইমামরা যখন মসজিদে জুমার নামাজের খুৎবা দেন, তখন কালোবাজারি বা মজুতদারি বা খাদ্যে ভেজাল দেয়া আর অযথা মানুষকে কষ্ট দেয়া যে গর্হিত কাজ, সে ব্যাপারে মানুষকে আপনাদের আরো বলা উচিত। খুৎবায়ও এটা বলতে পারেন বা মানুষকে সচেতন করতে পারেন।

তিনি বলেন, সেভাবেই কাজ করতে আমি মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খাদেমগণকে অনুরোধ করব। তাহলে মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফা নেয়ার প্রবণতা নিশ্চই কমবে। নিম্ন আয়ের মানুষের নায্য মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার পারিবারিক কার্ডের ব্যবস্থা করেছে ্উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা অধিক দামে চাল ক্রয় করে ৩০ টাকা মূল্যে বিভিন্ন পরিবারকে দিচ্ছি। রমজানকে সামনে রেখে আরো ১ কোটি মানুষকে ১৫ টাকা কেজি দরে আমরা চাল সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছি এবং একেবারে কর্মক্ষমতাহীনদের বিনাপয়সায় ৩০ কেজি করে চাল দিয়ে যাচ্ছি। মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্য সরকার নায্য মূল্যে এই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের কাজ সরকার যাতে আরো ভালোভাবে এগিয়ে নিতে পারে, সেজন্য সবার কাছে দোয়া চান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, এদেশের একটি মানুষও ভূমিহীন-গৃহহীণ থাকবে না। তার সরকার গৃহহীন-ভূমিহীনকে বিনামূল্যে ঘরবাড়ি এবং জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কৃষিতে সরকার ভর্তুুকি দিচ্ছে। শ্রমিকদের কল্যাণে নানামুখি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন এবং ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। বিদেশগামীদের জন্য প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকে বিনা জামানতে ব্যাংক ঋণেরও ব্যবস্থা করেছে।

কেউ দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে গিয়ে শেষে ভূমধ্য সাগরে যুবে মরবে, এটা তার সরকার চায় না বলেই সব ধরনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তৃতীয় ধাপে এসব মডেল মসজিদ উদ্বোধন করেন।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান ও মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসানও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৪ বছর ইসলামের খেদমতে বহু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৩ সালে ঢাকায় ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির স্বীকৃতি দিয়েছে। আরবি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পবিত্র কোরআনের ডিজিটাল ভার্সন তৈরি করেছে। বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ তিনটি ভাষায় পবিত্র কোরআন পড়া ও শোনার সুযোগ পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, আমরা জাতীয় শিক্ষা নীতিতে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা এবং মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমকে জাতীয় শিক্ষা নীতির অন্তর্ভুক্ত করেছি। সম্প্রতি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে এসি স্থাপন, চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে ন্যস্ত করা এবং ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩ হাজার ১২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদি মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের সপ্তম পর্যায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১ কোটি ২১ লাখ ৫১ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রাক-প্রাথমিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে তার সরকার ৭৫ হাজার ৮৮৩ জন আলেমের সম্মানীর ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে বলেও তিনি জানান।

সরকার প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদ্রাসা স্থাপন ও পরিচালনা’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ১ হাজার ১০টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বার্ধক্যজনিত কারণে কর্মে অক্ষম ও অসহায় ইমাম-মুয়াজ্জিনদের কল্যাণে আমাদের সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ‘ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করেছে। এই ট্রাস্ট হতে দুস্থ ইমাম-মুয়াজ্জিনদের এককালীন আর্থিক সাহায্য ও সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হচ্ছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দেশের মসজিদগুলোর আয় হ্রাস পাওয়ায় প্রায় আড়াই লাখ মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনদের অনুকূলে ৫ হাজার টাকা হারে ১২২ কোটি ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। করোনাকালীন কওমি মাদ্রাসার আয়ের পথ রুদ্ধ হওয়ায় দেশের প্রায় ১৪ হাজার কওমি মাদ্রাসায় ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মসজিদগুলোকে ইসলামী জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে মসজিদ পাঠাগার স্থাপন প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে প্রায় ২৮ হাজার মসজিদ পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ‘মসজিদ পাঠাগার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ২ হাজার ৫০০ নতুন পাঠাগার স্থাপন ও আড়াই হাজার পাঠাগারে পুস্তক সংরক্ষণের জন্য আলমারি দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

শরীয়ত সম্মতভাবে যাকাত সংগ্রহ, বিতরণ, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার সুবিধার্থে এ বছর ‘যাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ২ লাখ ১২ হাজার ৬৪৭ জন ইমামকে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, ৯৫ হাজার ৮৫ জনকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ৩৪ হাজার ৩৩০ জন ইমামকে রিফ্রেসার্স প্রশিক্ষণ এবং ৩ হাজার ৬১৩ জন ইমামকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ইমাম-খতিবরা তাদের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজেরা যেমন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন তেমনি তাদের পরামর্শে মসজিদ এলাকার জনগণও উপকৃত হচ্ছেন।

একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে জাতির পিতা ইসলামের নামে স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্চার ছিলেন উল্লেখ করে ইসলামের খেদমতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে আয়োজন এবং এরজন্য জায়গা প্রদান, কাকরাইল মসজিদের জায়গা প্রদান, কম খরচে হজ পালনের জন্য হিযবুল বাহার জাহাজ ক্রয় এবং রেডিও টিভিতে অধিবেশনের শুরু ও সমাপ্তিকে কোরআন তেলাওয়াতের ব্যবস্থাসহ বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

এ প্রসঙ্গে জাতির পিতার কন্যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের আগে যে ঐতিহাসিক বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন তার চুম্বকাংশ উদ্ধৃত করেন।

জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আমরা ইনসাফের ইসলামে বিশ্বাসী। আমাদের ইসলাম হযরত নবী করীম (সা.) এর ইসলাম, যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকারের এটাই প্রচেষ্টা সারাদেশে ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কেউ যেন বাড়াবাড়ি করতে না পারে এবং সত্যিকারের ইসলামিক শিক্ষা মানুষ যেন পেতে পারে। যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এবং আমাদের নবী করিম (সা.) ও বলেছেন। আর এদেশের মানুষ যাতে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদক গ্রহণের পথে না যায়, সেজন্য ধর্ম সম্পর্কে আরো অধিক প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই দেশ উন্নত হোক, এগিযে যাক। বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারীর প্রতি সহিংতা, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি করা একান্তভাবে প্রয়োজন। ইসলামই নারীর অধিকার নিশ্চিত করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। কেন না, শেষ বিচারতো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন করবেন। বিচারের ভার আল্লাহ মানুষকে দেননি। কেউ এই ধর্ম পালন করে না বলে তাকে খুন করে ফেলা ইসলামের শিক্ষা নয়। এটা আমি যেমন বিশ্বাস করি, তেমনি যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করেন এবং নবী করিম (সা.) এর নির্দেশ মানেন, তারাও এতে বিশ্বাস করবেন। আর এই খুন-খারাবি করতে গিয়ে বিশ্বের কোনো কোনো জায়গায় আজকে ধর্মকেই অসম্মান করা হচ্ছে। দুর্নাম দেয়া হচ্ছে, সবচেয়ে শান্তির ধর্মের নামে কুৎসা দেয়া হচ্ছে কিছু লোকের জন্য। যেটা আমাদের জন্য দুঃখজনক।

যার যার দ্বীনি বিশ্বাস, সে সে পালন করবে- মর্মে তিনি পবিত্র কোরাআনের নির্দেশ ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন’ উল্লেখ করেন।