ঢাকা ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সীতাকুণ্ডের শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতার আশঙ্কা

সীতাকুণ্ডের শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতার আশঙ্কা

সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে দুর্ঘটনার ঘটনায় মামলা হওয়ার পর মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। গত বুধবার রাতে গ্রেপ্তার করার পর এক পরিচালককে কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে তোলা হয়। কোমরে রশি বেঁধে আদালতে নেয়া শিল্পপতি সীমা গ্রুপের পরিচালক পারভেজ উদ্দীন সান্টু। মূলত তাঁকে অপমানজনকভাবে আদালতে উপস্থাপন করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন সেখানকার বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক। এ ঘটনায় গতকাল শুক্রবার মালিকপক্ষের আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে সব অক্সিজেন প্ল্যান্ট বন্ধ রাখা হয়। সীতাকুণ্ড এলাকায় অবস্থিত অন্তত ১২ প্ল্যান্টে অক্সিজেন উৎপাদন হয়নি। অনির্দষ্টকালের এ ধর্মঘটে জাহাজ ভাঙা শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ ভাঙা জাহাজ কাটতে প্রয়োজন হয় অক্সিজেন সিলিন্ডার। পাশাপাশি হাসপাতাল ও ক্লিনিকেও অক্সিজেনের সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এভাবে আন্দোলন চলতে থাকলে শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা স্থায়ী রূপ নেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে সীতাকুণ্ডের জলাধারগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। গভীর নলকূপ বসিয়ে নির্বিচার পানি উত্তোলন করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যে পুকুর জলাশয় চিহ্নিত করে খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

অক্সিজেন প্ল্যান্ট মালিককে গ্রেপ্তার বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) নেতারা প্রতিবাদ সভায় মিলিত হন। সভায় গ্রেপ্তারের পর কোমরে রশি বেঁধে সীমা গ্রুপের পরিচালক পারভেজ উদ্দীন সান্টুকে আদালতে হাজির করার প্রতিবাদ করেন। এজন্য চট্টগ্রামের সব অক্সিজেন প্ল্যান্ট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন ব্যবসায়ীরা।

সভায় বিএসবিএ’র সভাপতি মোহাম্মদ আবু তাহের বলেন, অক্সিজেন প্ল্যান্ট মালিকদের গ্রুপের পরিচালক গ্রেপ্তার ও লাঞ্ছনার প্রতিবাদে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেন চট্টগ্রামের অক্সিজেন প্ল্যান্ট মালিকরা। তিনি বলেন, চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপ সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের পরিচালক পারভেজ উদ্দীনের মত শীর্ষ ব্যবসায়ীকে কোমরে দড়ি দিয়ে লাঞ্ছিত করার মত ঘটনা দেশের ব্যবসায়ী সমাজের জন্য অপমানজনক। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী সমাজ ছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

শিল্পপতিকে কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নেয়ার ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ও পারভেজ উদ্দীন সান্টুর মুক্তির দাবিতে আজ শনিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে মানববন্ধনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দাবি মেনে নেয়া না হলে পরবর্তীতে সব শিপইয়ার্ড বন্ধের হুঁশিয়ারি দেন বিএসবিআরএ সভাপতি। প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএসবিএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট জহিরুল ইসলাম রিংকু, সদস্য লিয়াকত আলী চৌধুরী, মাস্টার আবুল কাশেম, নাঈম শাহ ইমরান, সিমনি গ্রুপের এমডি লায়ন মোহাম্মদ ইমরান, বিএসবিআরএ-এর সদস্যগণ, বায়ার এসোসিয়েশনের প্রতিনিধিসহ অন্যান্য শিল্প গ্রুপের মালিক ও প্রতিনিধিরা।

এদিকে শিল্পপতিকে কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নেয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন বিজিএমইএ। এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে এক বিবৃতি পাঠিয়েছেন। এতে তিনি বলেন, উদ্যোক্তাগণ শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আগে তা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন স্তরে চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেন। এক্ষেত্রে সীমা প্ল্যান্টেও অগ্নি নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কাজে নির্ধারিত কর্মকর্তা নিয়োজিত ছিল। অগ্নিদুর্ঘটনার তদন্ত করে জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়নি। এসব না করেই একজন শিল্পোদ্যোক্তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অপমানজনকভাবে কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এতে শিল্পমালিক মহলে ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এতে বিভিন্ন শ্রেণীর শিল্প উদ্যোক্তাগণ চরম হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এ ধরনের কর্মকান্ড সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সমাজকে ক্ষেপিয়ে তোলার পাঁয়তারা কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় শিল্প মালিকগণ প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক সহযোগিতায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ব্যাপক শিল্পায়নে প্রাণান্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার ফলে ব্যবসা বাণিজ্যসহ শিল্প প্রসারে উদ্যোক্তাগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। যা বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় দেশের শিল্পায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিবৃতিতে তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্প উদ্যোক্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিবেচনায় তাঁদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন ও সম্মান নিশ্চিতকরণসহ ভবিষ্যতে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।

দড়ি বেঁধে আদালতে নেয়ায় এসআই ক্লোজড : এদিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনার মামলায় গ্রেফতার হওয়া সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের পরিচালক পারভেজ উদ্দিন সান্টুকে কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নেওয়ার অভিযোগে এক এসআইকে ক্লোজড করা হয়েছে। অরুণ কান্তি বিশ্বাস নামে ওই এসআই শিল্প পুলিশে কর্মরত। ১৫ মার্চ পারভেজ উদ্দিন সান্টুকে হাতকড়া পরিয়ে এবং কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে তোলার একটি ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি ভাইরাল হয়। বুধবার রাতেই শিল্প পুলিশের ওই এসআইকে ক্লোজড করা হয়। চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সুলাইমান জানান, এসআই অরুণের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

গত ৪ মার্চ বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে কদমরসুলের কেশবপুর এলাকায় সীমা স্টিলের অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কয়েক কিলোমিটার এলাকা। ঘটনাস্থলের প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিটকে পড়ে বিস্ফোরিত ইস্পাতের টুকরো। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২১ ইউনিটট ২৩ ঘণ্টায় আগুণ নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ৭ জন নিহত এবং আহত হন প্রায় ৩০ জন।

এ ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি গত ১৪ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের কাছে দেয়া প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা রোধে নানা সুপারিশ করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ৪ ঘণ্টার মধ্যেই ওই রাতেই সীমা অক্সিজেনের পরিচালক পরিচালক পারভেজ উদ্দিন সান্টুকে গ্রেপ্তার করে শিল্প পুলিশ। গ্রেপ্তার পারভেজ সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানায় দায়েরকৃত মামলার দুই নম্বর আসামি।

পানি সংকটের জন্য শিল্প কারখানা দায়ী : সীতাকুণ্ড এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সীতাকুন্ডের কারখানাগুলো নিয়ম নীতি অনুসরণ না করেই স্থাপন করেছে গভীর নলকুপ। এক কারখানায় তিন চারটি পর্যন্ত গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এতে সীতাকুণ্ড এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানি সঙ্কট তীব্র রুপ নিয়েছে। সাধারণ নলকুপ বসাতে দেড় হাজার ফুটের বেশি নিচ পর্যন্ত পাইপ লাইন পৌঁছাতে হয়। না হয় পানি উঠেনা। পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ায় পুকুর জলাশয় প্রায় পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। নির্বিচার পানি উত্তোলনের কারণে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তাই সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট দুর্ঘটনায় আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস পর্যাপ্ত পানি পায়নি। এতে ক্ষতির মাত্রাও বেড়ে গেছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, দ্রুত আগুন নেভানোর উপর অগ্নি দুর্ঘটনায় ক্ষতির মাত্রা কম বেশি হওয়া নির্ভর করে। আগুন যত বেশি সময় জ্বলবে ক্ষতির মাত্রাও তত বেশি বাড়বে। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টেও একই ঘটনা হয়েছে। বেশি সময় লেগেছে অগ্নিনির্বাপনে। এতে ক্ষতিও হয়েছে বেশি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, তারা সীতাকুণ্ডের শিল্পাঞ্চলে জরীপ চালিয়ে পুকুর জলাশয় খননের উদ্যোগ নেবে। এতে অগ্নিদুর্ঘটনার সময় পানি শূন্যতার সমস্যা থাকবেনা। এজন্য ২৪টি পুকুর ছড়া জলাধার নিয়ে সমীক্ষাও চালানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত