ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশের জ্বালানি খাতে নতুন দ্বার উন্মোচন

দেশের জ্বালানি খাতে নতুন দ্বার উন্মোচন

বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের অস্বস্তির মধ্যেই স্বস্তির জোগান দিয়েছে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন (আইবিএফপিএল)। গতকাল শনিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে প্রথম আন্তঃসীমান্ত পাইপলাইনটির উদ্বোধন করেন। এর পরই পাইপলাইনে ভারত থেকে বাংলাদেশে ডিজেল সরবরাহ করা হয়, যা দেশের জ্বালানি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে।

প্রকল্পের বাস্তবায়নে সহযোগিতা করায় নরেন্দ্র মোদিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, এই পাইপলাইন বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং উভয় দেশের জনগণকে উপকৃত করবে।

জ্বালানি তেলের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একমাত্র আমদানিকারক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১০ লাখ টন জ্বালানি আমদানির পরিকল্পনা করেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের আওতায় ভারত থেকে ডিজেল আমদানির জন্য ভারত অংশে ৫ কিলোমিটারসহ প্রায় ১৩১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরজুড়ে ভারত থেকে ডিজেল সরবরাহ করবে বাংলাদেশ। দুই দেশের প্রকৃত বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে পাইপলাইন প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এটি দুই দেশের মধ্যে সেরা সম্পর্কের সাক্ষ্য হিসেবে থাকবে। নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায় ডিজেলচালিত ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু হলে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি আমদানির পরিমাণ বাড়বে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানি এটি অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। এতে জ্বালানি তেলের সরবরাহ খরচ কমে। একই সঙ্গে লাইনের মাধ্যমে একটি ডিপো থেকে আরেকটি ডিপোতে জ্বালানি সরবরাহ করায় ঝুঁকিও কমে যায়। পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে ২ লাখ টন ডিজেলে সরবরাহ করা হবে। যা আমাদের ডিজেলের চাহিদার তুলনায় কম। বছরে সর্বোচ্চ ১০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল সরবরাহ করলে ভালো হবে।

জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এই পাইপলাইন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই ভারত থেকে ডিজেল আমদানিকে বাংলাদেশ বিকল্প উৎস হিসেবে দেখছে। দাম বেশি হলেও জ্বালানি খাতে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারে আরও বেশি জ্বালানির সংকট তৈরি হলেও পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে খুব সহজেই ডিজেল আমদানি করা যাবে। বর্তমানে প্রতিটি ব্যারেল জ্বালানি পরিবহনে খরচ হয় প্রায় ১১ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার। কিন্তু পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে জ্বালানি আমদানি খরচ ৬ ডলার কমবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, ‘ভারত থেকে বাংলাদেশে পাইপলাইনে ডিজেল আমদানির কার্যক্রম দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। উদ্বোধনের দিনে ভারত থেকে পাইপলাইনের ১ কোটি লিটার ডিজেল বাংলাদেশে এসেছে। পাইপলাইনে ডিজেল আমদানি করায় জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হবে এবং কমে আসবে পরিবহণ ব্যয়ও। এতে খুব সহজে উত্তরবঙ্গে ডিজেল সরবরাহ করা যাবে। ভারত সরকার এই পাইপলাইনের অবকাঠামো নির্মাণ করে দিয়েছে। আর আমরা পাইপলাইনের জন্য ভূমি বরাদ্দ এবং রিসিভ ট্যাংক নির্মাণ করেছি।’ জানা গেছে, বিপিসির পক্ষে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (এমপিএল) ও ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) পাইপলাইন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পে ভারত সরকার ৩০৩ কোটি টাকা ও বিপিসি ২১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। তবে প্রকল্পের এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। তেল সংরক্ষণের জন্য নতুন ডিপো এখনো তৈরি হয়নি। ২৯ হাজার টন তেল মজুত করার জন্য এই ডিপো তৈরি করা হচ্ছে। আপাতত পুরোনো ডিপোতে মজুত করা হবে। সেখানে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন তেল মজুত করা যাবে। উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ীভাবে জ্বালানি সরবরাহে ২০১৮ সালে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নির্মাণ শুরু হয়। ভারতের নুমালীগড় থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর ডিপো পর্যন্ত বিস্তৃত এই পাইপলাইনে দিনে অতিরিক্ত ২৯ হাজার টন জ্বালানি মজুত সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের সংশ্লিষ্টরা জানান, পাইপলাইন উদ্বোধন করায় উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল পরিবহণ নিয়ে আর বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না বিপিসিকে। ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন কমিশনিংয়ের পর প্রথম বছর আড়াই লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত ডিজেল আমদানি করা হবে। পর্যায়ক্রমে প্রতি বছর ডিজেল আমদানির পরিমাণ বাড়ানো হবে। ১০ ইঞ্চি ব্যাসের এই পাইপলাইন দিয়ে বছরে সর্বোচ্চ ১০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বিপিসির কর্মকর্তারা বলেন, পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল সরবরাহ ও পরিচালন ব্যবস্থা আধুনিক হয়েছে। এতে জ্বালানি তেল পরিবহণ ব্যয় ও সময় সাশ্রয় হবে। খুলনা ও চট্টগ্রাম থেকে রেল ওয়াগনের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল পরিবহণের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাজনিত কারণে ওয়াগন থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় পরিবেশ দূষণ হ্রাস পাবে এবং ক্ষতির পরিমাণ কমবে। ইন্দো-বাংলা ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনে যুক্ত পার্বতীপুরের তিনটি তেল বিপণন কোম্পানির স্থাপনা থেকে দৈনিক ১ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৭০ থেকে ৭২ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা ৪৮ থেকে ৪৯ লাখ মেট্রিক টন, যার ৮০ শতাংশ সরকার আমদানি করে। বর্তমানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হচ্ছে। আর পরিশোধিত তেল আমদানি করা হয় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, কুয়েত, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বজুড়ে জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে কম খরচে নতুন উৎস থেকে ডিজেল আমদানির পথ খুঁজছে সরকার। ভারত থেকে পাইপলাইনে ডিজেল আমদানিকে বিকল্প উৎস হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ডিজেল আমদানির জন্য রাশিয়া ও ব্রুনেইর সঙ্গেও আলোচনা করছে সরকার। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের রিসিপ্ট টার্মিনাল কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ অটোমেটিক মেশিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এখানে হিউম্যানের হাতের কোনো কার্যক্রম থাকবে না। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল সরবরাহ চালু হলে উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মোতাবেক ডিজেল ভারত থেকে সহজ, সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্নভাবে সাশ্রয়ী মূল্যে আমদানি করা যাবে। এতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা আরো সুদৃঢ় হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত