১৯ মার্চ ১৯৭১

গাজীপুরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ

প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

জয়দেবপুরে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে এ সম্মুখ যুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সমগ্র বাংলাদেশে স্লোগান ছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ১৯৭১ সনের ১৯ মার্চ। দেশ যখন অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল তখন গাজীপুরের শান্তিকামী জনতা স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি হানাদারদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গাজীপুরের তৎকালীন নাম ছিল জয়দেবপুর। ১৯৭১ সালে জয়দেবপুর সেনানিবাসের ভাওয়াল রাজবাড়ীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কার্যালয় ছিল। সেখানে ২৫-৩০ জন ছাড়া সবাই ছিলেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। পাকিস্তানিরা বাঙালি দমনের নীল নক্সা অনুযায়ী ১৫ মার্চের মধ্যে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। বাঙালি সৈন্যরা রাজি না হলে ১৯ মার্চ সকালে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব অস্ত্র ও গোলা বারুদ নিতে জয়দেবপুর সেনানিবাসে আসেন। এ খবর জানাজানি হলে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে জনতা, লাঠি, তীর-ধনুক নিয়ে জয়দেবপুর বটতলায় জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওই প্রতিরোধযুদ্ধে মনু খলিফা, কিশোর নিয়ামত, ফুটবলার হুরমত আলী ও কানু মিয়া শহীদ হন। আহত হন আরো অনেকে। জয়দেবপুরে পাক হানাদারদের সঙ্গে এ সম্মুখ যুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সমগ্র বাংলাদেশে স্লোগান ছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ১৯৭১ সনের ১৯ মার্চ জয়দেবপুর থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ ঘটনার বর্ণনা দেন প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিরোধে অংশ নেয়া মো. নুরুজ্জামান আকন্দ। তিনি তৎকালীন গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলেন। ওই দিনের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, বেলা আনুমানিক ১১টার দিকে রানী বিলাসমনি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চান্দনা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে জয়দেবপুর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার ঘটনা জানায়। পরে ওই দুই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি আসে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে ভিপি আসকর আলী সরকার, মাইরাল চেয়ারম্যানের ছেলে দেলোয়ার হোসেন, ছাত্রনেতা নিয়ত আলী ওরফে আমজাদসহ তারা সব নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী একযোগে জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হন। ততক্ষণে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে রাজবাড়ি ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়ে। অস্ত্রসহ কমপক্ষে ১৫টি জিপ গাড়িতে করে দুপুর আনুমানিক ১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা রাজবাড়ি থেকে বের হয়। ওইসব নেতাকর্মী শিক্ষার্থীরা রাজবাড়ি সড়কের বর্তমান পোস্ট অফিসের সামনে অবস্থান নেয়। প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। দুই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব ছিল আনুমানিক ৫০০ ফুট। পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন বাঙালি জোয়ান বাংলা ভাষায় ছাত্র-জনতাকে সড়ক থেকে অবরোধ তুলে নিতে অনুরোধ করে। ছাত্র-জনতা অবরোধে অনড় থাকলে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালাতে বাধ্য হবে বলে ঘোষণা দেয়। এক পর্যায়ে একটি বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়। তাৎক্ষণিক পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে অবরোধকারীদের লক্ষ্য করে সড়কের দুই পাশে অস্ত্র তাক করে অবস্থান নেয়। এবারও অবরোধ তুলে নিতে অনুরোধ করে। কিছুক্ষণ পর আবারো আরেকটি বাঁশির আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর মুহুর্মুহু গুলি ছোঁড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা।

স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাসের এ দিনটি গাজীপুর তথা দেশবাসীর নিকট একটি গৌরবময় দিন। দিনটিকে জাতীয়ভাবে পালনসহ সেদিন নিহত শহীদ পরিবারদের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার দাবি করছে স্থানীয় এলাকাবাসী ও নিহতের স্বজনরা। শহীদ নিয়ামতের ভাই কেরামত আলীর অভিযোগ, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তাদের দৈন্য দশা কাটেনি। এখনো টিকে আছে শহীদ নিয়ামত আলীর রেখে যাওয়া মাটির ঘর।’ তৎকালীন মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেদিন বীর বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও দিনটিকে জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে না।’ শহীদ পরিবারের লোকজন জানান, স্বাধীনতার এত বছর পরও শহীদদের স্বজনদের দিন কাটছে নানা কষ্টে। শহীদ পরিবারের নামে বরাদ্দ করা জমি, সুবিধাদি দেয়াসহ তাদের রয়েছে নানা দাবি। অবশ্য ১৯ মার্চের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে চান্দনা চৌরাস্তায় নির্মাণ করা হয়েছে স্মারক ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ এবং জয়দেবপুর বটতলায় ‘মুক্তমঞ্চ’। প্রতি বছর পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় গাজীপুরবাসী এ দিনটি উদযাপন করেন। এবারও রয়েছে নানা আয়োজন।