শিবচরে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ : আহত ২৫ জন

* তদন্ত কমিটি গঠন * দুর্ঘটনার বর্ণনা দিলেন মহারাজ খাঁ * ক্যাম্পাসে ফেরা হলো না মিমি ও সুইটির

প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

মাদারীপুরের শিবচরে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। গতকাল রোববার কমপক্ষে ৪৪ জন যাত্রী নিয়ে চাকা ফেটে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পদ্মা সেতুর আগে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে প্রায় ৫০ ফুট নিচে পড়ে গেলে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় বাসটি দুমড়েমুচড়ে গেলে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হয়। আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে আরো পাঁচজন মারা যান। নিহতদের লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাসুদ আলম বলেন, খুলনা থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী ইমাদ পরিবহনের বাসটির সামনের ডান পাশের চাকা এক্সপ্রেসওয়েতে ফেটে যায়। এতে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় চালক বাসের নিয়ন্ত্রণ হারান। এ সময় বাসটি রেলিং ভেঙে খাদে পড়ে দুমড়েমুচড়ে যায়।

পুলিশ ও শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জন হলেন গোপালগঞ্জে গোপীনাথপুর এলাকার তৈয়ব আলীর ছেলে হেদায়েত মিয়া, বনগ্রাম এলাকার শামসুল শেখের ছেলে মোস্তাক আহমেদ, সদর উপজেলার নশর আলী শেখের ছেলে সজীব শেখ, পাচুরিয়া এলাকার মাসুদ হোসেনের মেয়ে সুইটি আক্তার, টুঙ্গিপাড়ার কাঞ্চন শেখের ছেলে করিম শেখ, সদর উপজেলার আবু হেনা মোস্তফার মেয়ে আফসানা মিমি ও মুকসুদপুর এলাকার আমজেদ আলীর ছেলে মাসুদ আলী, খুলনার সোনাডাঙা এলাকার শেখ মোহাম্মদ আলীর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন, সাউথ মেন্টাল রোড এলাকার চিত্ত রঞ্জন ঘোষের ছেলে চিন্ময় প্রসূন ঘোষ, ডুমুরিয়া এলাকার পরিমল সাদু খার ছেলে মহাদেব কুমার সাদু খা, আমতলা এলাকার শাহজাহান মোল্লার ছেলে আশফাকুর জাহান লিংকন, বাগেরহাট জেলা শহরের শান্তি রঞ্জন মজুমদারের ছেলে অনাদি মজুমদার, ফরিদপুরের হিদাডাঙ্গা এলাকার সৈয়দ মুরাদ আলীর ছেলে মো. ইসমাইল হোসেন, নড়াইলের লোহাগড়া এলাকার বকু শিকদারের ছেলে ফরহাদ শিকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলী আকবরের ছেলে ও ইমাদ পরিবহন বাসটির চালক জাহিদ হাসান, চালকের সহকারী মিরাজ এবং পাবনার সুজানগরের গহর আলীর ছেলে ইউসুফ আলী, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার মানিকদি গ্রামের মিজানুর রহমান বিশ্বাসের ছেলে মিনহাজ ও আলী আকবরের বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায়।

শিবচর ফায়ার সার্ভিসের লিডার তরুণ অর রশিদ বলেন, সামনের বাম পাশের চাকা ফেটে নিয়ন্ত্রণ হারায় বাসটি। দ্রুত গতির হওয়ায় এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে যায়। দুমড়েমুচড়ে যায় বাস। চালক দ্বিখণ্ডিত হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিবুল ইসলাম বলেন, লাশের পরিচয় শনাক্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আমরা ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছি।’ এই ১৯ জনের মধ্যে ১৪ জনের লাশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়। বাকি পাঁচজনের মধ্যে তিনজনকে আহত অবস্থায় শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেয়ার পথে তারা মারা যান। আর দুইজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ বলছে, বাসটি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পান্থপথ শাখা ও ইমাদ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির যৌথ নামে কেনা। কোম্পানির মালিক হাবিবুর রহমান শেখ। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের আলিয়া মাদ্রাসা রোডের হারুন টাওয়ারে। এ ব্যাপারে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, বাসটি আগেও দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। তখন এর চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল। এরপরও বাসটি চালানো ঠিক হয়নি। বাসের নিবন্ধন বাতিল ও মালিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ক্যাম্পাসে ফেরা হলো না মিমি ও সুইটির : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আফসানা মিমি (২৫)। ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট আনতে। তার ইচ্ছা ছিল বিসিএস ক্যাডার হয়ে পরিবারের হাল ধরবেন। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা কেড়ে নিল মিমির প্রাণ। একই অবস্থা গোপালগঞ্জ শহরের পাচুরিয়া এলাকার মাসুদ মিয়ার (৬০) মেয়ে সুইটির (২০)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) পড়ুয়া মেয়েকে ঢাকায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন তিনি। বাস দুর্ঘটনায় তার মেয়ে সুইটি নিহত হন।

প্রশিক্ষণে যোগ দিতে পারলেন না অনাদি রঞ্জন : স্বামী-স্ত্রী দুজনই সরকারি চাকরিজীবী। শুক্র ও শনিবার ছুটি থাকায় তারা চলে যান নিজ বাড়ি বাগেরহাট শহরে। তবে এই সপ্তাহে দুইজন নয়, স্ত্রীকে রেখেই গ্রামের বাড়িতে যান অনাদি রঞ্জন মজুমদার (৫৫)। ঢাকায় একটি প্রশিক্ষণে যোগ দিতে গোপালগঞ্জ থেকে বাসে ওঠেন তিনি। পথে মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। অনাদি রঞ্জন মজুমদার গোপালগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক (ডিডি)। তার স্ত্রী অনিতা দত্ত ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষক।

বাস দুর্ঘটনার বর্ণনা দিলেন মহারাজ খাঁ : ‘চলতে চলতে দেখলাম হঠাৎ গাড়ি বামে মোড় নিছে।

লোকজন চিৎকার শুরু করে। এরপর গাড়ি উল্টে গেল। এরপর আমার আর মনে নাই। বাসটা যে কতবার উল্টাইছে নিজেও বলতে পারি না। এরপর বাস খাদে পড়ে যায়।’ এভাবেই দুর্ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মহারাজ খাঁ (৩০)। খুলনা থেকে ইমাদ পরিবহনের বাসে করে ঢাকা যাচ্ছিলেন মহারাজ। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী হালিমা আক্তার। এদিকে খুলনা থেকে আবিদ শেখ যাচ্ছিলেন মুন্সীগঞ্জ। তিনি টঙ্গীবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাহপুরে জনতা ব্যাংকে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘খুলনা থেকে ভোরে আমি বাসে উঠি। শিবচরে বাস উল্টে যাওয়ার পর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে দেখি স্থানীয় এক ভাই আমার পাশে।’

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের। শোকবার্তায় নিহত ব্যক্তিদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন তিনি। পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। শোকবার্তায় জিএম কাদের বলেন, জীবনের যেন মূল্যই নেই। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। প্রতিদিনই সড়কে মৃত্যুর মিছিল। অথচ কোনো প্রতিকার নেই। যেন সড়ক দুর্ঘটনারোধে কারো কোনো দায় নেই।

প্রতিদিনের দুর্ঘটনা যেন নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে যৌক্তিক সহায়তা দিতে হবে।

এই বাস দুর্ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে শিবচর উপজেলা প্রশাসন। আগামী দুই দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। বিষয়টি নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাজিবুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পল্লব কুমার হাজরাকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।