বছরে বিপিসির সাশ্রয় হবে ৮০০ কোটি টাকা

জুনে গভীর সাগর থেকে পাইপ লাইনে আসবে জ্বালানি তেল

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা পরিশোধিত (রিফাইন) ও ক্রুড (অপরিশোধিত) জ্বালানি তেল পরিবহণে পুরোনো নিয়ম বদলে যাচ্ছে। আগামী জুনে বন্দর বহির্নোঙর থেকে অয়েল লাইটার ট্যাঙ্কারে করে পরিবহণ ও খালাসের পরিবর্তে ব্যবহার হবে পাইপ লাইন। সমুদ্রের তলদেশে স্থাপন করা পাইপ লাইন সরাসরি যুক্ত হচ্ছে পতেঙ্গায় অবস্থিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) স্টোরেজ ট্যাঙ্কে। দিনে গড়ে ৫০ হাজার মেট্রিন জ্বালানি তেল খালাস হবে পাইপ লাইনের মাধ্যমে। আমদানি করা জ্বালানি তেল খালাসে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) দুই লাইটার ট্যাঙ্কার আর দরকার হবে না। বিপিসির কাছে এমটি বাংলার সৌরভ আর এমটি বাংলার জ্যোতির প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে। এভাবে অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে পাইপ লাইনে সরাসরি জ্বালানি তেল স্টোরেজ ট্যাংকে খালাসের কারণে বছরে বিপিসির সাশ্রয় হবে অন্তত ৮০০ কোটি টাকা। বিপিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমদানি করা জ্বালানি তেলবাহী অয়েল ট্যাঙ্কার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে নোঙর করত। সেখান থেকে লাইটার ট্যাঙ্কারে করে জ্বালানি তেল নিয়ে আসা হতো পতেঙ্গায় অবস্থিত ডলফিন অয়েল জেটিতে। সেখানে রজ ট্যাঙ্কার থেকে স্টোরেজ ট্যাংকে জ্বালানি তেল খালাস করা হতো। এতে নানা ধরনের সমস্যা হতো। বন্দর বহির্নোঙর থেকে স্টোরেজ ট্যাঙ্ক পর্যন্ত জ্বালানি তেল পরিবহন বাবদ বিপিসির বিপুল অর্থ ব্যয় হতো। পরিবহনের সময় নানা কারণে অপচয় হতো জ্বালানি তেল। চুরিও হয়ে যেত আমদানি করা জ্বালানি তেলের একটি অংশ। এতে বেড়ে যেত সিস্টম লস। আর অয়েল লাইটারে করে খালাসের কারণে সময় ব্যয় হতো বেশি। তাতে বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে আসা বড় অয়েল ট্যাঙ্কার চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করতে দেরি হয়ে যেত।

দ্রুত জ্বালানি তেল খালাস, খালাসে সময় হ্রাস ও পরিবহণ খাতে ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এটির কাজ শেষ হলেই গভীর সাগর থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত দুই ধরনের জ্বালানি তেল পরিবহণ শুরু হবে। বড় অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে খালাস হওয়া এসব জ্বালানি তেল আসবে পতেঙ্গায় অবস্থিত স্টোরেজ ট্যাঙ্কে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) স্টোরেজ ট্যাঙ্কে তেল খালাস হবে সরাসরি। দিনে গড়ে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল খালাস হবে এই পাইপ লাইনে। ৬ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে জ্বালানি তেল খালাসের জন্য পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মাধ্যমে তেল খালাস করে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হবে না। সেই সঙ্গে বিএসসির দুইটি অয়েল লাইটার ট্যাঙ্কার এমটি বাংলার সৌরভ ও এমটি বাংলার জ্যোতির মাধ্যমে তেল খালাসে নির্ভরতাও থাকবে না। অর্থাৎ, বড় ট্যাঙ্কার থেকে আমদানি করা জ্বালানি তেল খালাসে এই দুটি ট্যাঙ্কার আর প্রয়োজন হবে না।

এ ব্যাপারে বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া বলেন, পাইপ লাইনের মাধ্যমে আগামী জুনে ক্রুড রিফাইন (অপরিশোধিত ও পরিশোধিত) জ্বালানি তেল পরিবহণ হবে। আশা করছি আগামী জুন মাসেই শুরু হবে তেল পরিবহণ। এতে দুই ধরনের উপকার হবে। পাইপ লাইনের মাধ্যমে ক্রুড পরিবহণ হলে অপারেশন্স লস কমবে। পাশাপাশি বিপুল অঙ্কের ক্রুড পরিবহণ ব্যয়ও কমবে বিপিসির।

প্রকল্পটির নাম ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্প পরিচালক ও ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) মহাব্যবস্থাপক মো. শরিফুল হাসনাত বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে শেষ হচ্ছে প্রকল্পের কাজ। এরপর থেকে পুরোদমে গভীর সাগর থেকে পতেঙ্গায় পাইপ লাইনের মাধ্যমে ক্রুড রিফাইন দুই ধরনের জ্বালানি তেল পরিবহণ শুরু হবে। সেই সাথে প্রকল্পের সুফল ঘরে আসবে।

ইআরএলের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স অ্যান্ড প্ল্যানিং) রায়হান আহমেদ বলেন, ডলফিন অয়েল জেটিতে ভিড়ে লাইটার ট্যাঙ্কার থেকে জ্বালানি তেল খালাসের পুরো চিত্রই বদলে যাবে। এই জেটি আর আমদানি করা জ্বালানি তেল খালাসের জন্য দরকার হবে না। বড় অয়েল ট্যাঙ্কারে আমদানি করা জ্বালানি তেল গভীর সাগর থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরাসরি খালাস হবে স্টোরেজ ট্যাংকে। এতে সময় ও অর্থ দুই ক্ষেত্রে সাশ্রয় হবে।

বিপিসি সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ক্রুড পরিবহণ হচ্ছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) দুই লাইটার ট্যাঙ্কার ‘এমটি বাংলার সৌরভ’ ও ‘এমটি বাংলার জ্যোতি’র মাধ্যমে। এতে বিপিসির পরিবহণ ব্যয় বাবদ বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হতো। লাইটার ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহণ করায় অপারেশনস লস বাবদ বিপুল ক্ষতি হতো। বিপিসি বিএসসিকে ক্রুড পরিবহণ বাবদ প্রতি মাসে বিপুল অর্থ পরিশোধ করত। মূলত পরিবহণ এবং অপারেশন্স খাতে অর্থ সাশ্রয় করতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ক্রুড পরিবহণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর এই প্রকল্পের সুফল পাওয়ার সময় এখন কাছাকাছি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণ প্রকল্প থেকে অনেক ধরনের সুফল মিলবে। প্রতি মাসে বিপিসি ১ লাখ মেট্রিক টন ক্রুড আমদানি করে থাকে। পাশাপাশি এক থেকে দেড় লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। এসব ক্রুডবাহী বৃহদাকার মাদার অয়েল ট্যাঙ্কার নোঙর করে কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে। চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে নোঙর করতে পারে না। চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে নোঙর করতে পারে পরিশোধিত জ্বালানি তেলবাহী অয়েল ট্যাঙ্কার। মাদার ট্যাঙ্কারে করে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা হয় ক্রুড।

পাইপ লাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে অবস্থানকারী এক লাখ টন ধারণক্ষমতার মাদার ট্যাংকার দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল) জ্বালানি তেল নিয়ে আসা হবে। রিফাইনারির স্টোরেজ ট্যাঙ্কেই ভর্তি করা হবে পাইপ লাইনে আনা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল।

বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে গড়ে ৭০ লাখ টনের কাছাকাছি জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। এর মধ্যে ১২ লাখ মেট্রিক টন থেকে ১৫ লাখ মেট্রিক টনের মতো ক্রুড বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়। বাকি আমদানি তেলের সবই পরিশোধিত অবস্থায় আনা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানি করা হয় এসব পরিশোধিত জ্বালানি তেল। অয়েল ট্যাংকার কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে এসব জ্বালানি তেল লাইটারিং করে ইস্টার্ন রিফাইনারির স্টোরেজ ট্যাঙ্কে নিয়ে আসা হয়। এই খাতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি) বছরে গড়ে ৮০০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়।

পাশাপাশি ১ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল লাইটারিং করতে গড়ে ১১ থেকে ১২ দিন সময় লাগে। ১ একটি মাদার অয়েল ট্যাংকার থেকে খালাস প্রক্রিয়া শেষ করতে লাগত ১২ থেকে ১৪ দিন। এ সময়ের জন্য জাহাজ মালিককে বিপুল ভাড়া পরিশোধ করতে হতো বিপিসিকে। এছাড়া মাদার অয়েল ট্যাংকার থেকে লাইটারেজ করার সময় জ্বালানি তেল অপচয়, নষ্ট হয়। বহু তেল চুরিও হয়। এভাবে বিপিসি প্রচুর সিস্টেম লসের কবলে পড়ে। এ ধরনের কঠিন সংকট কাটাতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং জাহাজ থেকে তেল খালাসে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে গভীর সাগরে একটি ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও অর্থাভাবে ঝুলে ছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে চীন সরকার আগ্রহ দেখায়।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চীনের এক্সিম ব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তায় ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের আওতায় চায়না পেট্রোলিয়াম ব্যুরো মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ নির্মাণ করবে এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত অফশোর এবং অনশোর মিলে মোট ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন বসানো হচ্ছে। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন এবং ৭৪ কিলোমিটার অনশোর পাইপলাইন।

বর্তমানে পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। কক্সবাজারের মহেশখালী এলাকায় ৯০ একর জায়গার ওপর ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংক ও পাম্প স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংকের তিনটিতে পরিশোধিত এবং অপর তিনটিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মজুত করা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার এবং অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার।

জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল ও পরিশোধিত তেল সরাসরি ভেসেল মুরিং পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখান থেকে পাম্প করে পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংকে এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে পুনরায় পাম্পের মাধ্যমে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠানো হবে। ডাবল পাইপ লাইনের একটি দিয়ে ক্রুড অয়েল এবং অপর পাইপ লাইন দিয়ে রিফাইনড অয়েল সরবরাহ দেয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত এবং ২৮ ঘণ্টায় ৭০ হাজার টন পরিশোধিত ডিজেল খালাস করা যাবে।

সূত্র জানায়, প্রকল্পটির কাজ আরো অনেক আগে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে মেয়াদ বৃদ্ধি হয়। তিন দফা সংশোধন করে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। সময় বাড়ার সাথে সাথে প্রকল্পটির ব্যয় ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিপিসির অধীনে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে।