ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রমজানে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি

চরম দুর্ভোগে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ

চরম দুর্ভোগে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ

প্রত্যেক বছরের মতো পবিত্র রমজান মাসে এবারও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পাইকারি বাজারে সিন্ডিকেট করায় মাছ, মাংস, চাল-আটা, তেল-চিনি, ডাল-ময়দা ও মসলাসহ কনফেকশনারি পণ্যের দাম খুচরা পর্যায়ে ক্রমাগত বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কাঁচা তরকারির দামও। দ্রব্যমূল্যের এই পাগলা ঘোড়া কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে গোল বেগুনের কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লম্বা বেগুনের দামও মানভেদে ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। প্রতি হালি বড় আকারের লেবু ৬০ থেকে ৮০ টাকা এবং ছোট লেবু ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, টমেটো ৪০ থেকে ৫০ টাকা, গাজর ও শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, প্রতি কেজি ধনেপাতা ১২০ থেকে ২০০ টাকা, পুদিনাপাতা ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, মানভেদে মসুর ডালের দাম প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, খোলা চিনি প্রতি কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিনের দাম প্রতি কেজি ১৯০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

গত বছরের চেয়ে এবারের রমজানে খেজুরের দাম বেড়েছে। দুই ইঞ্চি লম্বা ‘জাম্বো মেডজুল’ খেজুরের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি, যা গত বছর ছিল ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি। সাধারণ মেডজুল এবার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা কেজি, যা গত বছর ছিল ৮০০ টাকা। সৌদি আরবের ‘মাবরুম’ ও ‘আজওয়া’ খেজুরের দাম ১ হাজার টাকা কেজি। একটু নিম্নমানের মাবরুম কেনা যাবে ৯০০ টাকায়। সবচেয়ে ভালো মানের মরিয়ম খেজুরের দাম ৯০০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকা কেজি। গত বছর এর দাম ছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। ‘আম্বার’ ও ‘সাফাভি’ নামের দুই ধরনের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা কেজি। এর দাম গত বছর ছিল ৬৫০ টাকা। এছাড়া যেসব খেজুর পাওয়া যাচ্ছে, এর মধ্যে আছে ‘সুক্কারি’ ৭৫০ টাকা কেজি, ‘আদম’ ৬০০ টাকা, জর্ডানের ‘জুয়েল’ ৭০০ টাকা, আলজেরিয়ান ‘রয়্যাল’ ৫০০ টাকা, ‘মাশরুক’ ৪৫০ টাকা, ‘আলজেরিয়ান খেজুর’ ৩৬০ টাকা, ‘দাবাস ক্রাউন’ ৩৪০ টাকা, ‘দাবাস প্লেন’ ৩০০ টাকা।

এদিকে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জে হাওরের বাঁধ পরিদর্শন শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, সরকার চেষ্টা করছে নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনার। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার অভিযান পরিচালনা করছে।

অযৌক্তিক দামে বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করায় চার কোম্পানিকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এরপর কোম্পানিগুলো খামার পর্যায়ে নির্ধারিত দামে মুরগি বিক্রি করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেখানে মুরগির খামার পর্যায়ে দাম ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা নির্ধারণ করেছে চার কোম্পানি। শিগগিরই কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের খামার পর্যায়ে এ দামে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করবে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে মুরগির দাম কতো হবে সেটা নির্ধারণ হয়নি।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বলেছেন, কোম্পানিগুলো গতকাল ২৩০ টাকায় খামার পর্যায়ে ব্রয়লার বিক্রি করেছে। আজ (শুক্রবার) থেকে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় বিক্রি করবে। আশা করছি ভোক্তা পর্যায়ে এখন দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমবে।

সফিকুজ্জামান আরো বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা ও ভোক্তার কর্মকর্তারা আমাকে জানিয়েছেন সারাদেশের পাইকারিতে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায় ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে। সেটা হাতবদলে ২৬০ টাকা হচ্ছে খুচরায়। আশা করছি দুই-তিন দিনের মধ্যে মুরগির দাম কমে আসবে।

বর্তমানে অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে মাংসের বাজার। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা, সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ থেকে ৩৯০ টাকা কেজি। প্রতি ডজন ডিম ১৪০ টাকা। গরুর মাংস ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কাপ্তান বাজারে পাইকারি পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগি ২৪৫ থেকে ২৫০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি ব্রয়লার সিলেটে ২২৬ টাকা, কুমিল্লায় ২২৪ টাকা, হবিগঞ্জে ২২১ টাকা, নরসিংদীতে ২২০ টাকা, টাঙ্গাইলে ২১৮ টাকা, ময়মনসিংহ ও গাজীপুরে ২১৫ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা যায় ভোক্তা অধিদপ্তরের তদারকিকালে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সারাদেশে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এটি চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে গত ২ বছরে নিত্যপণ্যের দ্রব্যমূল্যের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, খুচরা বাজারে নিত্যপণ্যের মধ্যে চাল, ডাল, মসলা, চিনি, তেল থেকে শুরু করে মাছ, মাংস এবং সবজির দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে মানুষের আয়ের কোনো মিল নেই। ফলে মধ্য মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সংসার চালাতে গিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে।

২০২০ সালে খোলা বাজারে মোটা চাল ৩৬ টাকার কাছাকাছি ছিল। এখন মোটা চাল ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। একই অবস্থা চিকন চালের ক্ষেত্রে। অথচ চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার কয়েক দফা শুল্ক কমিয়ে আমদানির অনুমতি দেয়। কিছু চাল আমদানিও হয়েছে। এরপরও এ বছর চালের দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে। মাঝে মাসখানেক স্থির থেকে ফের বাড়ছে।

গত সপ্তাহে এ ধরনের চালের দাম ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। মাঝারি (পায়জাম, লতা, বিআর-২৮) চালের কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং সরু চালের (মিনিকেট) কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা দরে। এক সপ্তাহ আগে মাঝারি চাল ৫৪ থেকে ৫৮ এবং সরু চাল ৬২ থেকে ৭২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবার। আয়ের তুলনায় ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ায় পরিবারের মধ্যে তৈরি হয়েছে বাজার ভীতি।

একটু কম দামের আশায় শনির আখড়া থেকে গুলিস্তান কাপ্তান বাজারে মুরগি কিনতে আসা সবুজ মিয়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা। সেজন্য পাইকারি বাজারে একসঙ্গে কয়েক কেজি মুরগি কিনতে এসেছি। শনির আখড়ার তুলনায় এখানে কেজিতে ৫ টাকা দাম কম।

গাইবান্ধা জেলা শহরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাছান মাহমুদ শিপন বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি মধ্যেও ২২ হাজার টাকা বেতনে পরিবারের সব ধরনের খরচ ও মাস শেষে কিছু টাকা সঞ্চয় করা যেত। কিন্তু গত এক বছরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এভাবে বাড়তে থাকলে মানুষের জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব আরো গভীর হবে। আপাতত খরচ কমাতে যথাসম্ভব বাজার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি।

চালের দাম গড়ে ২ শতাংশ বেড়েছে : সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলেছে, এক মাসে সব ধরনের চালের দাম গড়ে ২ শতাংশ বেড়েছে। কারওয়ান বাজারের হাজী ইসমাইল অ্যান্ড রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন বলেন, চালের দাম বেড়েছে, এটা বলা ঠিক হবে না। দুই-এক টাকা মাঝেমধ্যে ওঠানামা করে।

আশরাফুল তালুকদার নামে ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, পরিবারে নিয়মিত ব্যয় বাড়লেও আয় আগের পরিমাণই আছে। অবস্থা এমন কাউকে কিছু বলার বা চাওয়ার মতো অবস্থাও থাকে না। প্রতি মাসে এখন নিজ বেতন খরচ করে ধারদেনা করে চলতে হয়। নিলয় নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আগে ১ লিটার প্যাকেটজাত তেল ৯০ টাকায় কিনেছি। এখন তার অর্ধেক পরিমাণ কিনতে হচ্ছে ১১০ টাকায়। আমরা শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ সময় প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ জোগাড় করি। দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। মাছ, মাংস থেকে শুরু সবজি সবকিছুতেই ক্রেতার চাহিদা কমেছে।

মাতুয়াইল বাজারের সবজি বিক্রেতা আবুল বশর বলেন, বাজারে ক্রেতা তেমন না কমলেও চাহিদা কমেছে। যেসব ক্রেতা আগে ব্যাগভর্তি সবজি কিনতেন, তারা এখন হিসাব করে কিনছেন।

কারওয়ান বাজার আলুর আড়তদার ফয়সাল মাহমুদ বলেন, দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে আলু সংগ্রহ করে ট্রাকে কারওয়ান বাজারে আনা হয়। আলু সরবরাহ থেকে শুরু করে ঢাকায় পৌঁছা পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। আবার আগের তুলনায় ট্রাকের খরচ বেড়েছে। সেজন্য গ্রামাঞ্চলে আলুর দাম কম থাকলেও ঢাকায় এসে তা দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

পাইকারি বাজারে সিন্ডিকেট করা হচ্ছে- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে কারওয়ান বাজারের সবজি পাইকারি ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম জানান- জনগণ ভাবছেন- পাইকারি এবং খুচরা বাজারে রয়েছে বিশাল ফারাক। বেগুন খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি প্রায় ১০০ টাকার ওপরে বিক্রি হলেও পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার নিচে। তবে, পচনশীল দ্রব্য হওয়ার কারণে খুচরা বিক্রেতারা অধিক দামে বিক্রি করতে হয়।

খালেক নামের আরেক সবজি বিক্রেতা বলেন, রোজার প্রথম দিকেও বাজার এমনই থাকবে। হুট করে খুব বেশি দাম বাড়ার আশঙ্কা কম। যা বাড়ার, আগেই বেড়েছে। আবার শেষ দিকে দাম কমে আসবে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ঢাকা মহানগরে ২০২২ সালে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম ১১ শতাংশ বেড়েছে। ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেড় দশকে দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন), মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে। তবু ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে। নিম্নমধ্যবিত্তের প্রকৃত আয় খুব একটা বাড়েনি। অধিকাংশ আয়ই বেড়েছে উচ্চবিত্তের। ফলে দেশে দিন দিন আয়ের বৈষম্য বাড়ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত