ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

শীতকালে প্রচণ্ড হিমের চাদর মুড়ে ঝিমিয়ে থাকে বিশ্বপ্রকৃতি। বসন্তের আগমনে চারদিকে প্রাণের শিহরণ লাগে, গাছপালা পত্রপল্লবে সজ্জিত

হয়, পাখিরা কূজন করে। ঋতুচক্রের এই পরিবর্তন চোখে দেখা যায়, বিশ্বাস করতে যুক্তির প্রয়োজন হয় না। প্রাকৃতিক জগতে বসন্তের সমারোহের মতো অন্তর্জগতেও আছে ঋতুপরিক্রমণ, বসন্তের শিহরণ, যা চর্মচক্ষে দেখা যায় না, অন্তরের চেতনায় উপলব্ধি করতে হয়। এই পরিবর্তন আধ্যাত্মিক, অতিপ্রকৃতিক। প্রাকৃতিক জগতের ঋতু পরিক্রণের সম্পর্ক সূর্যের গতিপথের সাঙ্গে। আর আধ্যাত্মিক পরিবর্তন আসে প্রধানত চাঁদের পরিক্রমণের প্রভাবে। চন্দ্রবর্ষের এই পরিক্রমায় আমাদের কাছে আজ উপস্থিত হয়েছে পবিত্র মাহে রমজান।

গ্রীষ্মের তাপদাহের পর রাস্তার ধারে ডোবায় জলাশয়ে ব্যাঙের অবিরাম ডাকাডাকি জানান দেয় বর্ষা এসেছে। দেখতে দেখতে মুষলধারে বৃষ্টি নামে, খালবিল পানিতে থইথই করে, মাছ ও জলজপ্রাণির উৎসব শুরু হয়। রমজানের আধ্যাত্মিক বসন্ত বুঝা যায়, যখন মোমিন মুসলমানের অন্তরজগৎ আধ্যাত্মিক আনন্দে নেচে ওঠে। বর্ষায় খালবিল ভরে যাওয়ার মতো শহরে-গ্রামে সর্বত্র মসজিদ ভরে ওঠে মুসলমানদের কোলাহলে। সাহরির জন্য শেষ রাতের জাগরণ, পরস্পর ডাকাডাকি, দিন শেষে ইফতারের আয়োজন, তারাবিতে কোরআন খতম, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মসজিদে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড় প্রমাণ দেয়, রমজানের আধ্যাত্মিক বসন্তকাল শুরু হয়েছে।

আমাদের ছাত্রজীবনে বই-খাতা বা শিক্ষকের নির্দেশনার বাইরে জ্ঞানের কোনো উৎসের কথা আমরা জানতাম না। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কথা বলা হলে তা আমাদের কাছে কাল্পনিক ধ্যাণ-ধারণার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। জীবনের এ পর্যায়ে এসে দেখছি বই খাতার চেয়েও শক্তিশালী একটি মাধ্যম হলো অন্তর্জাল, ইন্টারনেট। জ্ঞানের তথ্য সরবরাহের জন্য সক্রিয় গুগল মাস্টার। ফলে আজকের প্রজন্মকে আধ্যাত্মিক বিষয়ের বাস্তবতা যুক্তিতর্কে সাজিয়ে বুঝানোর প্রয়োজন হয় না। তারা সহজে বুঝে নেয় বই-খাতার বাইরে অদৃশ্যলোকে যেমন একটি নেট দুনিয়া আছে, তেমনি দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে একটি আধ্যাত্মিক জগৎ আছে এবং তাতেও ঋতুর পরিক্রমণ চলে। এ কারণে রমজানে বিশ্বপ্রকৃতিতে আধ্যাত্মিক বিবর্তনের বাস্তবতা, অঝোর ধারায় অফুরান রহমতের বর্ষার সত্যতা বুঝানোর জন্য যুক্তিতর্কের প্রয়োজন হয় না।

হ্যাঁ, প্রতি বছর মাহে রমজান আসে অফুরন্ত রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে। শাবান মাসের শেষ শুক্রবার এক খুতবায় নবীজি (সা.) রমজান মাসের এই মহিমা ও গুরুত্বের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের ওপর ছায়াপাত করেছে একটি মহান মাস। একটি বরকতময় মাস। এমন মাস, যার মধ্যে একটি রাত আছে, যে রাত এক হাজার মাসের চেয়েও মহিমান্বিত, উত্তম। এই মাসের রোজা আল্লাহতায়ালা ফরজ সাব্যস্ত করেছেন এবং এই মাসে রাত জেগে ইবাদত অর্থাৎ তারাবি নামাজ পড়া অতিরিক্ত সওয়াবের উপলক্ষ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। যে ব্যক্তি এই মাসে কোনো নেক ও কল্যাণকর কাজ আঞ্জাম দিল, সে যেন রমজান বাদে অন্য সময়ে একটি ফরজ বিধান পালন করল। আর যে রমজানে কোনো ফরজ ইবাদত করল, সে যেন রমজান ভিন্ন অন্য সময়ে ৭০টি ফরজ পালন করল।’ সোজা কথা কমপক্ষে একে সত্তর গুণ।

শীতকাল আমাদের দেশে শাকসবজি ও রবিশস্য উৎপন্ন হওয়ার মৌসুম। শীতের আমেজে রবিশস্যের ফলন যেভাবে হয়, অন্য সময়ে হাজার চেষ্টা করেও তেমন ফলন হয় না। গ্রীষ্মের শেষভাগে মধুমাসে আম-লিচুর রসে ম ম করে সবদিকে। মধুমাসের বাইরে আম-লিচুর এমন বাম্ফার ফলন চেষ্টা করেও ফলানো সম্ভব নয়। পবিত্র মাহে রমজানও হলো ইবাদতের মৌসুম। এ জন্য এ মাসে যে কোনো সৎকাজের সওয়াব ৭০ গুণ বা তার চেয়ে বেশি। সওয়াবের এই তারতম্য হয় ব্যক্তির নিয়ত, নিষ্ঠা তথা আল্লাহর জন্য কতখানি নিবেদিতপ্রাণ হলো, তার ওপর।

আমাদের সব ইবাদত-বন্দেগি ও রমজানের সাধনার মূলে নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ সৎকর্মের পেছনে নিয়ত হতে হবে শুদ্ধ। একমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে হলেই তার সওয়াব পাওয়া যাবে। নিয়তের বিশুদ্ধতার তারতম্য অনুপাতে সওয়াবেও তারতম্য হবে। অনেক সময় দৃশ্যত দুনিয়াদারির কাজও নিয়তের কারণে ইবাদতে পরিণত হয়। আবার নিছক ইবাদত-বন্দেগিও, দুনিয়া কামানো, মানুষকে দেখানো বা নাম কুড়ানো উদ্দেশ্য হলে সওয়াবের পরিবর্তে গোনাহের কারণ হয়ে যায়। মূলত মনের স্বচ্ছতা, নিয়তের বিশুদ্ধতা ও নিষ্ঠাই বান্দার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কাম্য ও কাঙ্ক্ষিত।

‘আর তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে যে, তারা যেন একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর দ্বীন পালনের মাধ্যমে একমাত্র তারই ইবাদত করে, নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত দান করে। এটাই হচ্ছে সরল ও মজবুত ব্যবস্থা। (সুরা আল বাইয়েনা : ৫)।

আল্লাহপাক মানুষের বেশভূষা চান না, তিনি চান স্বচ্ছ নির্মল অন্তর।

‘তোমাদের কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে কখনও পৌঁছে না, বরং তোমাদের আল্লাহভীতিই তাঁর কাছে পৌঁছে। (সুরা হজ : ৩৭)।

অন্তরে কি আছে সেটিই আল্লাহর কাছে বিবেচ্য ও বিচার্য।

‘আপনি বলুন, তোমরা তোমাদের মনের কথা গোপন রাখ অথবা প্রকাশ কর, তা সবই আল্লাহ জানেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ২৯)।

পবিত্র রমজানুল মোবারক যে শিক্ষা ও পয়গাম নিয়ে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মনের স্বচ্ছতা, নিয়তের বিশুদ্ধতা। মানুষ যাতে তার সব কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে সম্পাদন করে, ভোগ-বিলাসিতা ও স্বার্থসিদ্ধির পেছনে জীবন বরবাদ করে না দেয়, তার প্রশিক্ষণের মাস মাহে রমজান।

আমরা অনেক ভালো ভালো উপদেশ শুনি, অন্যদের উপদেশের বাণী শোনাই। পরক্ষণে ভুলে যাই। যদি সেই উপদেশ আমাদের অভ্যাস ও স্বভাবে পরিণত হয়, মজ্জাগত হয়ে যায়, তার প্রকৃত সুফল লাভ করা সম্ভব হয়। রমজানের দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনা হচ্ছে ভালো সুন্দর মানবীয় গুণগুলোকে আমাদের স্বভাবে পরিণত করার অনুশীলন। রোজাদার যাতে সুন্দর ও আদর্শ মানুষে পরিণত হয়। এ জন্যই রোজায় পানাহার ও যৌন সংসর্গ থেকে বিরত থাকার সঙ্গে নিজের নিয়ত ও চেতনাকে শুদ্ধ ও জাগ্রত রাখতে হবে। ধর্মীয় পরিভাষায় এর নাম ঈমান ও ইহতিসাব। নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে রমজানের রোজা রাখবে তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’

বস্তুত মানব সমাজে মাহে রমজানকে প্রেরণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে সংযমি সুন্দর ও আদর্শ মানুষ তৈরি করা। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘হে ওইসব লোক, যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত