রমজানের উপহার ২০ রাকাত তারাবি

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

রমজানে মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি উপহার তারাবি নামাজ। রমজানের শুরুতেই শহরে কিংবা গ্রামে- সর্বত্র মোমিন মুসলমানদের উপচেপড়া ভিড়ে মসজিদগুলো কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে। এতদিন নামাজের প্রতি যাদের অবহেলা ছিল, তারাও মসজিদমুখী হয়। দুপুরের পর থেকে রোজাদাররা যখন মসজিদ চত্বরে ক্লান্তভাবে বসে বসে তসবিহ তেলাওয়াতে নিমগ্ন হয়, দেখে মনে হয় তারা পরম শান্তির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। আল্লাহর রহমতের কাছে আশ্রয় চেয়েছে। আল্লাহর সান্নিধ্যের ছোঁয়া পেয়েছে।

সারাদিন উপবাস থেকে সন্ধ্যায় ইফতার ও মাগরিব নামাজের পর এশার আজান হয়, ক্লান্ত শরীরের সব জড়তা ঝেড়ে রোজাদার জামাতে শামিল হয়। অন্য সময় এশার সুন্নত নফল কম পড়ার প্রবণতা থাকলেও রমজানে এক অদম্য প্রেরণায় উজ্জীবিত থাকে সবাই। দীর্ঘ দেড় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোরআন খতমে শরিক হয়। সারা দিনমান সিয়াম সাধনায় শরীরের ক্লান্তি ও ভার নামিয়ে রেখে রাতে আত্মিক ভাবরসে সিক্ত মনে আল্লাহর কালাম শোনে পবিত্র অবস্থায়। এই দৃশ্য এই অভিজ্ঞতার মহিমা বর্ণনা কোনো কলমের দ্বারা সম্ভব নয়। এ জন্যই হাদিস শরিফে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে রাত জেগে ইবাদত করবে (সব মুহাদ্দিসের অভিন্ন মত হলো- রাত জেগে ইবাদত মানে রমজানের বিশেষ আয়োজন তারাবি নামাজ) তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ ইহতিসাব মানে আত্মচেতনা, আত্মসমালোচনা, জাগ্রত মনে সওয়াবের প্রেরণা।

তারাবি নামাজের প্রধান অনুষঙ্গ খতমে কোরআন। অর্থাৎ ৩০ পারা কোরআন মজিদ রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবি নামাজে একবার তেলাওয়াত করা। হাফেজ সাহেবরা নামাজে তেলাওয়াত করেন আর বিশুদ্ধ উচ্চারণের এই তেলাওয়াতে প্রাণ জুড়ানোর ব্যবস্থা থাকে মুসল্লিদের জন্য।

হজরত ওমর (রা.) রমজানের এক রাতে লক্ষ করেন সাহাবিরা বিক্ষিপ্তভাবে মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ছেন। তিনি উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে ইমাম নিযুক্ত করে সবাইকে তার পেছনে একত্রে নামাজ পড়ার আদেশ দিলেন। আরেকদিন লক্ষ করেন, লোকেরা ইমামের পেছনে তারাবি নামাজ পড়ছে সুন্দর শৃঙ্খলায়, প্রবল উদ্দীপনায়। তার মন তখন আনন্দে ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করলেন, অতিউত্তম বেদাত এটি।

বেদাত শব্দের অর্থ আগে ছিল না, এমন অভিনব কোনো জিনিস। নবী করিম (সা.) বা প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর আমলে জামাত সহকারে তারাবির নামাজের প্রচলন ছিল না, এ জন্য তিনি তারাবির জামাতকে অভিনব সুন্দর পন্থা বেদাত বলে প্রশংসা করলেন।

হজরত ওমর (রা.) প্রবর্তিত তারাবির জামাতের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের কেউ আপত্তি করেননি, কাজেই সাহাবায়ে কেরামের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ও আমল আমাদের জন্য শরিয়তের প্রামাণ্য ও অনুসরণীয় বিধান। যারা তারাবির নামাজ ৮ রাকাত বলতে চান, তাদের যুক্তি হলো নবীজি তারাবি ৮ রাকাত পড়েছেন বলে বর্ণনা আছে। ওমর (রা.) এসে ২০ রাকাত সাব্যস্ত করেছেন। আমরা রাসুলকে মান্য করব, ওমরকে নয়। যুক্তির কথা হলো, নবী করিম (সা.) তারাবির নামাজ ২০ রাকাত পড়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম তারই অনুসরণ করেছেন। হজরত ওমর (রা.) ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। নবীজির তারাবির নামাজের ধরন ও রাকাত সংখ্যা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম হজরত ওমরের আমলে একমত হয়েছেন, সে অনুযায়ী আমলও করেছেন। বাস্তবে অনুসরণ করেছেন। তারা সে সময় নবীজির সুন্নত হিসেবে যা বুঝতে পারলেন, আমল করলেন দেড় হাজার বছর পর এসে তার চেয়ে যারা বেশি বুঝতে চায়, তাদের সম্পর্কে কী বলা যায় আপনারাই বলুন। দেড় হাজার বছরের ইতিহাস প্রমাণ করে তারাবির নামাজ ২০ রাকাত। কোরআন মজিদ ৩০ পারায় বিন্যস্ত। প্রতিদিন এক পারা করে তেলাওয়াতের সুবিধার্থে ৩০ পারা বা খণ্ডে ভাগ করা হয়েছে। অন্যথায় তা সুরা আকারে নাজিল হয়েছে। সাধারণভাবে দেখবেন, কোরআন মজিদের প্রত্যেক খণ্ড বা পারা ১০ পাতা বা ২০ পৃষ্ঠায় সাজানো থাকে। রমজানে ২০ রাকাত নামাজে ২০ পৃষ্ঠা তেলাওয়াতের সুবিধার্থে যে এই বিন্যাস, তা সহজে অনুমেয়।

কোরআন মজিদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন থাকে। তন্মধ্যে একটির নাম রুকু। মুফতি শফী (রহ.) প্রণীত মাআরেফুল কোরআনের ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোরআন মজিদে মোট ৫৪০টি রুকু আছে। প্রতিদিন তারাবিতে এক রুকু করে তেলাওয়াত করলে ২৭ রমজান অর্থাৎ সম্ভাব্য শবেকদরের রাতে এক খতম কোরআন পুরা হয়ে যায়। কাজেই এতগুলো দলিল-প্রমাণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যারা তারাবি নামাজ ৮ রাকাত ২০ রাকাত জায়েজ নেই বলে বিভ্রান্তি ছড়ায়, তাদের সম্পর্কে কী বলা যায়। নেট দুনিয়ায় ইউটিউবে শায়খ আল্লামা পরিচয় দানকারী এসব আলখেল্লাওয়ালার শিকড় কোথায় কেউ জানে না। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকাই ঈমানের দাবি। এরা মুসলমানদের ইবাদত বন্দেগির ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি এবং সালেহিন বান্দা ঈমামরা; এমনকি স্বয়ং নবী করিম (সা.) এর সঙ্গে উম্মতের ভালোবাসার বন্ধন শিথিল করার মিশন নিয়ে কাজ করছে। এদের সুললিত বর্ণনার ফাঁদ সম্পর্কে সতর্ক থাকা চাই। এদেশের কওমি বা আলিয়া ঘরানার আলেমরা এতকাল ২০ রাকাত তারাবির চর্চা করেছেন। যদি তারাবি ৮ রাকাত পড়েন আপত্তি নেই, তাতে সুন্নতের ওপর আপনার আমল হবে না। কিন্তু যারা ২০ রাকাত পড়ে তারা নাজায়েজ কাজ করছে বলে ফতোয়াবাজি করছেন, এমন সাহস কোথায় পেলেন? তারাবি ৮ রাকাত পড়ে নামাজে এক খতম কোরআন শেষ করা কি সম্ভব হবে। নিশ্চয়ই না। জোর করলে পড়তে চাইলেও নামাজে ও তেলাওয়াতে সেই আরাম পাবেন না, যা ২০ রাকাত পড়ে পাওয়া যায়। এ জন্যই তাদের দেশেও মক্কা শরিফ ও মদিনা মুনাওয়ারায় রমজানে তারাবির নামাজ পড়া হয় ২০ রাকাত।