ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নফস ও রুহের যুদ্ধে রমজানের প্রশিক্ষণ

নফস ও রুহের যুদ্ধে রমজানের প্রশিক্ষণ

যেসব বস্তুর প্রাণ আছে, নড়চড় চলাচল করতে পারে তাদের আমরা প্রাণী বলি। এ হিসেবে মানুষও প্রাণী। প্রাণিজগতের অস্তিত্ব টিকে আছে দেহ ও প্রাণের ওপর। দেহকে ভর করেই প্রাণ সজীব সচল থাকে। দেহ না থাকলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকে না। আবার প্রাণ না থাকলে অসাড় দেহ পচে নষ্ট হয়ে যায়।

দেহ ও প্রাণের পরিচয়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী এক রকম দেখালেও উভয়ের মাঝে বিরাট পার্থক্য আছে। একটি পার্থক্য হলো, মানুষের যে প্রাণ আছে এবং যার ওপর জীবন-জীবিকা চলছে, তার সঙ্গে আরেকটি প্রাণ যুক্ত আছে, একে বলতে পারি প্রাণের প্রাণ। এর অপর নাম আত্মা।

মানুষের আত্মা আছে। অন্যান্য প্রাণীর আত্মা নেই। আত্মা আবার দুই প্রকার। একটিকে বলা যায় জীবাত্মা, অপরটি মানবাত্মা। জীবাত্মার স্বভাব পশুসুলভ। জীব জানোয়ার পশুরা যেমন খাওয়া আর যৌনতা ছাড়া অন্য কিছু বুঝে না, জীবাত্মারও সারাক্ষণ আকর্ষণ থাকে জৌবিক কামনা বাসনার দিকে। মানব চরিত্রের পশুত্বের এই স্বভাব যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, যদি জীবাত্মার অনুগত হয়ে যায়, তাহলে মানুষ পশুর চেয়েও হীন হিংস্র হয়ে যায়। কোরআন মজিদের ভাষায় ‘বল হুম আদাল।’ বরং ‘তারা এর চেয়েও নিকৃষ্ট’।

জীবাত্মাকে ধর্মীয় পরিভাষায় বলা হয় নফস। বাংলায় কুণ্ডরীপু বা কুপ্রবৃত্তি বলেও আখ্যায়িত করি। ভোগ, মোহ, কামাসক্তি, ক্রোধ প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র এই নফস। শয়তানের সঙ্গেই জীবাত্মা বা নফসের যোগাযোগ মাখামাখী। নফসের পথেই শয়তান মানুষের মনে আক্রমণ চালায়, কুমন্ত্রণা দেয়, মন্দ ও পাপের পথে নিয়ে যায়। পক্ষান্তরে মানবাত্মাকে ধর্মীয় পরিভাষায় আমরা রুহ বলতে পারি। রুহ সবসময় ভালোর দিকে সৎকাজের দিকে আকৃষ্ট করে। রুহের যোগাযোগ সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে।

মানব সত্তার অভ্যন্তরে এই নফস ও রুহ হরদম যুদ্ধরত। এই যুদ্ধের কারণে মানুষের মন সবসময় দোটানায় থাকে। কোন দিকে যাবে ঠিক পায় না। নফস শক্তিশালী হলে মন্দের দিকে নিয়ে যায়। যদি রুহ শক্তিশালী হয় ভালোর পথে পরিচালিত করে।

রুহ চায় মানুষকে আল্লাহর দিকে, কল্যাণের পথে, দুনিয়া ও আখেরাতে যা যা তার জন্য চূড়ান্ত সাফল্য বয়ে আনবে, সেদিকে ধাবিত করতে। নফসের চেষ্টা তার ঠিক উল্টা। নফস বলে ভালোমন্দ বিচার করার দরকার নেই। ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক।’ ‘দুনিয়া কা মজা লে লও দুনিয়া তোমারি হ্যায়।’ কাম, ক্রোধ, ভোগ লিপ্সা চরিতার্থ করার যত সুযোগ আছে নফস তা লুফে নিতে প্ররোচণা দেয়। রুহ তাতে বাধা দেয়। বলে, পার্থিব ভোগের রাজ্য চাকচিক্য মরিচিকা। একে স্বর্গরাজ্য মনে করলে পথ হারাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে। এ আকর্ষণ-বিকর্ষণে নফস ও রুহের মধ্যে যার শক্তি বেশি মানুষ সেদিকে ধাবিত হতে বাধ্য হয়।

ছোটবেলায় হাতির খেদার অনেক গল্প শুনতাম। গভীর জঙ্গলে হাতির খেদা বা ঘেরাও বেষ্ঠনী তৈরি করে বন্যহাতিকে আটকে রেখে কঠিন কঠোর শাস্তি ও পরিশ্রম দিয়ে মানুষের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা হয়। এমন তালিমে হাতি একেবারে সুবোধ বালকের মতো হয়ে যায়। এখনও চিড়িয়াখানা বা লোকালয়ে যেসব হাতি দেখা যায়, ওরা খেদায় ফেলে পোষ মানানো হাতি। ইসলামী মনীষীগণ বলেছেন, বন্যহাতিকে যেমন কঠিন কঠোর পরিশ্রমের নিগঢ়ে ফেলে অনুগত, শান্ত ও সুবোধ করে গড়ে তোলা যায়, সেভাবে অবাধ্য নফসকেও কঠোর কৃচ্ছ্রতা ও বিধিনিষেধের আওতায় রেখে অনুগত ও বাধ্য করা সম্ভব।

অসুরকে দমন করে সুরের উজ্জীবন বা নফসকে বশীভূত করে রুহের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন ধর্মে বা মতাদর্শে নানা কর্মপন্থা ও কসরত নির্দেশ করা হয়েছে? কোনো কোনো ধর্মে বিয়ে শাদী বর্জন, সংসার ত্যাগ, সন্নাসী জীবন ও বৈরাগ্য সাধনার কথা বলা হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ইসলামে বৈরাগ্য সাধনার স্থান নেই। ইসলাম বলেছে জীবনযাত্রা থেকে পলায়ন করে বৈরাগ্য সাধনায় সিদ্ধিলাভ অসম্ভব। কারণ এগুলো মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ। সমাজের সব মানুষের পক্ষে এমন সাধনায় নিয়োজিত হওয়াও সম্ভব নয়। তখন সমাজ সংসার অচল হয়ে পড়বে।

নফসের দমন আর রুহের লালনের জন্য ইসলাম যে কর্মসূচি দিয়েছে তা তুলনাহীন। দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ, পবিত্রতা অর্জনের জন্য অজু-গোসলের নিয়মকানুন, ধর্মীয় চেতনায় সমাজের সব মানুষকে নিয়ে জুমার সাপ্তাহিক সমাবেশ, বছরে দুটি ঈদ উৎসব, এক ঈদ আত্মশুদ্ধির মাসব্যাপী সাধনায় সাফল্য লাভের মহড়া। আরেক ঈদ আপন সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও সর্বনিয়ন্তা আল্লাহর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার অঙ্গীকারের আনুষ্ঠানিকতা এবং রমজানের মাসব্যাপী কৃচ্ছ্র সাধনাও এ লক্ষ্যেই নিয়োজিত। যাতে সংসার বিরাগী না হয়ে সবাই সংসারি সংযমী জীবনের অধিকারী হয়। লাআল্লাকুম তাত্তাকুন।

রমজানে দিনের বেলা লাগাতার একমাস নফসের কামনা-বাসনাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। এর ফলে মানুষের স্বভাব-চরিত্রের মন্দ দিকগুলো দমিত হয় আর ভালো ও সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর উজ্জীবন ঘটে এবং তা মানুষের স্বভাবের অংশ ও মজ্জাগত হয়ে যায়। এখানে শুধু বিশেষ পুরোহিত শ্রেণি বা সন্যাসী সাধক কিংবা আলেমরাই অংশ নেয়ে না; বরং সমাজের সর্বস্তরের নারী-পুরুষ একসঙ্গে উৎসবের আমেজে অংশ নেয়ার সুযোগ পায়। এ প্রশিক্ষণ মানুষকে জীবনযাত্রায় সীমালঙ্ঘন থেকে বাঁচার শক্তি জোগায় এবং তাকওয়ার গুণে সজ্জিত ও জান্নাতি হওয়ার যোগ্যতার অধিকারী করে। কোরআন মজিদে এরশাদ হয়েছে : ‘অনন্তর যে সীমালঙ্ঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দেয় জাহান্নামই হবে তার আবাস। পক্ষান্তরে যে স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং নফসের কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে বিরত রাখে জান্নাতই হবে তার আবাস।’ -(সুরা আন-নাযিয়াত, আয়াত : ৩৭-৪১)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত