আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার মাস

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

আমরা যখন বলি আমার খাতা, আমার কলম- বুঝা যাবে আমি আলাদা আর আমার কলম বা খাতা আলাদা। অনুরূপ যখন আমার হাত, আমার পা বা অন্য কিছু বলি- তখনও বুঝতে হবে, আমার হাত, পা, মাথা বা অন্য কিছু আমি নই, আমার চেয়ে ভিন্ন জিনিস। অর্থাৎ আমি বলতে যা বুঝায় তা আমার দেহ বা অন্য কিছু থেকে আলাদা এক ভিন্ন সত্তা। এই সত্তাই আমি এবং আমার আসল পরিচয়। দর্শনের এই সহজ কথাটুকু বুঝার পর সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমার দেহ ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আমার। আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে জীবনকে কোন পথে পরিচালিত করব। দেহ ও মন ঘোড়ার মতো। আমি তার উপর আরোহী। এই ঘোড়াকে লাগামহীন ছেড়ে দিতে পারব না। লাগাম হাতে রেখে যেদিকে আমার কল্যাণ আছে সেদিকে পরিচালিত করতে হবে।

আমার আমিকে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথম প্রয়োজন আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়া, নিজের ইচ্ছাশক্তিকে হাতের মুঠোয় রাখা। এর প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ নিয়ত ও সংকল্প। বিষয়টির গুরুত্ব অত্যধিক। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘সব আমল বা কাজের বিশুদ্ধতা ও ফলাফল নির্র্ভর করে নিয়ত বা সংকল্পের ওপর।’

আমাদের ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তা ও নিয়তের শুদ্ধতা অর্জনের প্রশিক্ষণ হয় মাহে রমজানে। প্রচণ্ড ক্ষুধা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত থাকা, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যৌন আবেদন উপেক্ষা করা সহজ বিষয় নয়। এর জন্য প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন। ইচ্ছাশক্তির জোরে মানুষ দেহ ও মনের চাহিদাগুলো নির্দয়ভাবে অস্বীকার করে। ফলে মনের ওপর রোজাদারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইচ্ছাশক্তির লাগাম নিজের হতের মুঠোয় চলে আসে। অনেক শিক্ষিত ও ভালো লোকের মধ্যেও কিছু ছোটখাটো বদঅভ্যাস লক্ষ করা যায়। ধূমপানের চেয়ে মারাত্মক পানে জর্দা খাওয়ার ব্যারাম কোনো কোনো আলেমের মধ্যেও দেখা যায়। পান-সিগারেট না খেয়ে নাকি অনেকে কয়েক ঘণ্টাও থাকতে পারে না। তবে রমজানে দেখা যায়, দিনের বেলা তারা এগুলো থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকেন। কিন্তু ইফতারের পর আবার যেই সেই। প্রশ্ন হলো, যেই ইচ্ছাশক্তির জোরে দিনের বেলা এসব মন্দ স্বভাব ত্যাগ করলেন, ইফতারের পর সেই ইচ্ছাশক্তি পরাজিত হয় কীভাবে। এভাবে রমজানের সিয়াম সাধনার মানেই বা কী হতে পারে। অবশ্য যারা নিয়ত করেন যে, এই রমজানের উসিলায় এসব বদঅভ্যাস ত্যাগ করব, তারা ঠিকই নতুন জীবন লাভ করেন।

কাজেই ইচ্ছাশক্তি বা নিয়ত ও সংকল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘নিয়্যতুল মুমিনি খাইরুম মিন আমলিহি।‘ অর্থাৎ ‘মোমিনের সংকল্প তার আমলের চাইতেও উত্তম।’

মাহে রমজান আমাদের নিয়ত, সংকল্প, চিন্তা ও পরিকল্পনা শুদ্ধ, সুন্দর ও মজবুত করার প্রশিক্ষণ দেয়। দিনমান সিয়াম সাধনার মধ্যে যে কোনো খারাপ চিন্তা মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। তখন ভালো, নেক ও সুন্দর চিন্তা এসে আসর জমায় মনের সিংহাসনে। এভাবে একটানা এক মাস সাধনায় মনের জমিন থেকে মন্দ চিন্তার আগাছা পরিষ্কার করে ভালো ও সুন্দর সব চিন্তার বীজ বপিত হয়। এর ভিত্তিতেই আমাদের জীবন, চরিত্র ও সমাজ সভ্যতা সুন্দর হয়।

আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মহাথির মুহাম্মদ সম্পর্কে একটি বক্তব্য পড়েছিলাম একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকায়। মহাথির মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় আসার পর তার দেশের শিক্ষিত তরুণদের বলেছিলেন, প্রত্যেকে ডাইরি লিখবে এবং ডাইরিতে প্রতিদিন যে যে ভালো চিন্তা ও কর্মপরিকল্পনার কথা মনে আসে লিখে রাখবে। এই ব্যবস্থাপত্র মালয়েশিয়ার জন্য অকল্পনীয় সুফল বয়ে এনেছিল। যুব সমাজ তাদের ভালো ভালো চিন্তা লিখে রাখতে লাগল। এমনকি ডাইরি লেখার প্রয়োজনে ভালো ভালো চিন্তা করতে বাধ্য হলো। এভাবে দেশব্যাপী গঠনমূলক উন্নত ও সুন্দর চিন্তা ডালপালা মেলতে লাগল, যার পরিণতি ছিল অস্বাভাবিক দ্রুততায় মালয়েশিয়ার উন্নয়ন। মাহাথির ও মালয়েশিয়ার উন্œয়ন সম্পর্কে এই বক্তব্য কতখানি যথার্থ সে বিশ্লেষণে না গিয়েও এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, সৎ সুন্দর কল্যাণ বলতে যা বুঝায় তার জন্ম হয় মানুষের চিন্তায়। সেই চিন্তা নিয়ত ও সংকল্পে পরিণত হলে ব্যক্তির আচরণ ও কর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।

মেরাজে আল্লাহ পাক নবী করিম (সা.)-কে জমিনের বাসিন্দাদের জন্য কয়েকটি উপহার দেন। একটি উপহার ছিল, আপনার উম্মতের কেউ যদি কোনো ভালো কাজের সংকল্প করে সঙ্গে সঙ্গে তার নামে একটি সওয়াব বরাদ্দ করা হবে। আর যদি সে কাজটি সম্পাদন করে বিনিময়ে কমপক্ষে ১০ গুণ সওয়াব দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে কেউ যদি কোনো মন্দ কাজের মনস্থ করে কাজটি সম্পাদন না করা পর্যন্ত কোনো গোনাহ লেখা হবে না। যদি মন্দ কাজটি করে ফেলে বিনিময়ে একটিমাত্র গোনাহ লেখা হবে। নিয়ত ও সংকল্পের অপরিসীম গুরুত্ব আমরা এখান থেকে অনুধাবন করতে পারি।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মহান প্রতিপালকের বরাতে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহতায়ালা সৎ কাজ ও অসৎ কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তারপর তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। অতএব কোনো ব্যক্তি যদি কোনো সৎ কাজের সংকল্প করে তা না করলেও তাকে আল্লাহ তাবারাক ওয়াতায়ালা একটি পূর্ণ নেকি দান করেন। আর যদি সে ওই কাজ করে, তবে আল্লাহ ১০ থেকে ৭০০ পর্যন্ত এমনকি তার চেয়েও বেশি সওয়াব তাকে দান করেন। আর যদি কেউ কোনো অসৎ কাজের সংকল্প করে তা না করলেও আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে একটি পূর্ণ সওয়াব দান করেন। আর সে সেই মন্দ কাজটি করলে আল্লাহ তার বিনিময়ে তার কারণে একটিমাত্র গুনাহ লেখেন। (বোখারি ও মুসলিম)।

আসুন, রমজানের সিয়াম সাধনায় আত্মবলীয়ান হই। নিজের মন ও প্রবৃত্তির গলায় লাগাম পরাই। আমার চরিত্র ও স্বভাবের অসুন্দর দিকগুলো চিহ্নিত ও বর্জন করি। সৎ সুন্দর ও মানবীয় গুণে সজ্জিত হওয়ার সংকল্প গ্রহণ করি। রমজানে বা পরে কী কী ভালো কাজ করব, তার একটি তালিকা মনের খাতায় তৈরি করি।