ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এনসিটিবির নতুন কারিকুলাম

পড়ার চাপ কম, আগ্রহ বাড়ছে শিক্ষার্থীদের

* বাড়তি খরচ ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবক * উদ্বেগের কারণ নেই, গাইড-কোচিং প্রয়োজন নেই : এনসিটিবি
পড়ার চাপ কম, আগ্রহ বাড়ছে শিক্ষার্থীদের

নতুন কারিকুলাম নিয়ে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর সমালোচনা থাকলেও এতে ক্রমেই আগ্রহ বাড়ছে শিক্ষার্থীদের। কারণ শিক্ষাবর্ষের তিন মাসেও গতানুগতিক কোনো পরীক্ষা না হওয়ায় পড়ালেখার তেমন কোনো চাপে নেই। উল্টো স্কুল থেকে নতুন পদ্ধতিতে যে হোম ওয়ার্ক ও গ্রুপ ওয়ার্ক দেয়া হচ্ছে, তা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে শিক্ষার্থীদের। এমনকি রমজানের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হলেও অনেকটা আনন্দের সঙ্গেই হোম ওয়ার্কের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

যদিও গতানুগতিক মূল্যায়ন না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার প্রতিযোগিতা কমে যাচ্ছে এবং এতে তাদের ভবিষ্যৎ জ্ঞানার্জন নিয়ে এখনো উদ্বেগের মধ্যে আছেন অভিভাবকরা। এছাড়া নতুন কারিকুলামের হোমওয়ার্ক বা গ্রুপ ওয়ার্কের বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে বাড়তি খরচ মেটানো নিয়েও চিন্তিত সংশ্লিষ্টরা। আর নতুন কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষকরা এখনও ঠিকমতো প্রশিক্ষিত না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্কুলে পড়ানো বা হোম ওয়ার্ক পদ্ধতিতে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।

তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নতুন কারিকুলামে গতানুগতিক পরীক্ষা বা মুখস্ত বিদ্যা না থাকায় শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে শিখবে ও বুঝবে, এতে তাদের পড়ালেখার চাপ কমবে এটাই স্বাভাবিক, আর হোম ওয়ার্ক বা গ্রুপ ওয়ার্ক সামগ্রী কিনতে কিছুটা খরচ হলেও তাদের কোচিং বা গাইড বাবদ বাড়তি খরচের প্রয়োজন হবে না। কেউ নোট-গাইড ব্যবহার ও কোচিং করলেও তাতে কোনো লাভ হবে না। পড়ানো এবং মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষকদের অস্পষ্টতাও শিগগিরই দূর হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে কোনো সংশয় ছাড়াই নিশ্চিতভাবেই এই কারিকুলাম এগিয়ে যাবে। এমনকি আগামীতে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের বইয়ের পাশাপাশি কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী স্কুল থেকে সরবরাহ করার চিন্তা করা হচ্ছে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সূত্র মতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তিনটি শ্রেণিতে এ বছর নতুন কারিকুলাম চালু হয়েছে। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এ নিয়ে প্রথম দিকে ব্যাপক ভীতি ও অনিশ্চয়তা থাকলেও শিক্ষাবর্ষের তিন মাসে তা অনেকটাই কেটে গেছে। এমনকি শিক্ষকরাও নতুন কারিকুলাম নিয়ে অন্ধকারে থাকলেও আস্তে আস্তে তা আয়ত্ত করছেন। এ কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ, নতুন বইয়ে তাদের আগের মতো মুখস্ত ও পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে না। ক্লাসে পড়া এবং হোম ও গ্রুপ ওয়ার্কের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয় আয়ত্ত করছে শিক্ষার্থীরা। এতে গতানুগতিক পড়ার চাপের চেয়ে শিক্ষকদের নির্দেশনা অনুযায়ী বাসায় ব্যক্তিগত ও গ্রুপ ওয়ার্ক নিয়ে অনেকটা খেলার মতো সময় পার করছে তারা।

যদিও শিক্ষার্থীদের এ অনুভূতির উল্টো চিত্র বিরাজ করছে অভিভাবকদের মাঝে। কারণ, এভাবে খেলার ছলে লেখাপড়া করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখতে পারবে এবং ভবিষ্যতে তা কতটুকু কাজে দেবে, তা নিয়ে অনেকটাই উদ্বিগ্ন তারা। বিশেষ করে আগের মতো কোনো মূল্যায়ন বা রোল নম্বর নির্ধারণের কোনো সিস্টেম না থাকায় শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতাও কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য তাদের। তাছাড়া নতুন কারিকুলামে পড়ার চেয়ে কাজ বাড়ায় সংশ্লিষ্ট সামগ্রী তথা পোস্টার, রঙ্গিন কাগজ, আট পেপার, ককশিট, আটা, রঙিন কলমসহ নানা জিনিস কিনতে অনেক ব্যয় ও হয়রানি বেড়ে গেছে বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন। আর নতুন পদ্ধতিতে ধারাবাহিক ও সামস্টিক মূল্যায়ন কীভাবে হবে, তা নিয়েও অন্ধকারে এবং উদ্বেগে আছেন অভিভাবকরা। এমনকি হোমওয়ার্ক দেয়া ও মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষকদেরও পুরোপুরি ধারণা নেই বলে জানা গেছে।

তবে এসব বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, একেক এলাকার স্কুলের শিক্ষক একেক রকম হোম ওয়ার্ক দেবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকার স্কুল শিক্ষার্থীদের পক্ষে যেভাবে ঢাকার যানজট সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। তেমননি ঢাকার শিক্ষার্থীদের পক্ষে পাহাড় ধসের মতো বিষয় নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়। তাই এলাকা ও অবস্থানভিত্তিক সমস্যা ও সমাধান নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাজ করতে হবে। আর এসব কাজ তারা আনন্দের সঙ্গে করছে কি না, তা দেখতে হবে।

তিনি বলেন, নতুন কারিকুলামের হোম ওয়ার্কে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে খরচ বাড়লেও এতে নোট, গাইড বই ও কোচিংয়ের কোনো প্রয়োজন হবে না। তাই এসব খাতের খরচ লাগবে না। এরপরও বর্তমানে সরকার যেভাবে বিনামূল্যের বই দিচ্ছে, আগামীতে স্কুল থেকে বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহ করতে পারে কি না, তা নিয়েও আমরা চিন্তা করছি।

এক প্রশ্নের জবাবে মশিউজ্জামান বলেন, নতুন কারিকুলামে নোট-গাইডের পাশাপাশি কোচিংয়ের কোনো প্রয়োজন হবে না। এতে শিক্ষার্থীদের কোনো লাভও হবে না। তাই যারা এসব কোচিংয়ের সঙ্গে এখনও যুক্ত আছেন তারা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন, ক্ষতি করছেন। কারণ, কোচিংয়ে সময় ব্যয় করলে শিক্ষার্থীরা নিজেরা চিন্তা ও মাথা খাটানোর সুযোগ পাবে না। তাই এ ধরনের হটকারি কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।

এর আগে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, কারো কোচিং ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কেউ কেউ ভাবছেন তাদের নোট-গাইডের ব্যবসা চলবে না। এজন্য নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করা হচ্ছে।

ভেতর থেকেও বিরোধিতা চলছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, আমরা কিন্তু সেটিও লক্ষ্য রাখছি। তিনি বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের বলব যে, পড়াশোনাটা ভালোভাবে করতেই হবে। মুখস্ত না, শিখে শিখে আত্মস্ত করে এবং সেটা যেন প্রয়োগ করা যায়।

তিনি বলেন, আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে, একটা নতুন শিক্ষাক্রম চালু করতে হলে অনেক রকমের কিছু করতে হয়। সেখানে অনেক ঘাটতি থাকতে পারে, অনেক সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু এই শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে, এটি চলবে। নতুন কারিকুলাম থাকবে, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আমাদের শিক্ষার্থীরা ইনশাআল্লাহ জেনে বুঝে শিখে প্রয়োগ করতে শিখে দক্ষ-যোগ্য মানুষ হবে। আমরা অনেক বেশি বিজ্ঞান প্রযুক্তির ওপর যেমন জোর দিচ্ছি, একই সঙ্গে মানবিক সৃজনশীল মানুষ হওয়া জরুরি। সেদিকেও আমরা জোর দিচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন চিন্তা করতে শেখে, যেন সমস্যার সমাধান করতে শিখে।

নতুন কারিকুলামের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অস্পষ্টতা : নতুন কারিকুলাম চালু হওয়ার তিন মাস পার হলেও এখনো মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অস্পষ্টতা আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, তা নিয়ে অভিভাবকরাও বেশ চিন্তিত। সূত্র মতে, এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়া ও হোম ওয়ার্কের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তবে এসব মূল্যায়ন ডাটা শিক্ষকরা কীভাবে সংরক্ষণ করবে তা, নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। একেক শিক্ষক একেকভাবে মূল্যায়ন কাজ চালাচ্ছেন। সব শেষে ৬ মাস ও বছর শেষে যে সামষ্টিক মূল্যায়নের কথা বলা হচ্ছে, তা কেমন হবে; এ নিয়েও অভিভাবকদের উদ্বেগ-কৌতূহলের শেষ নেই। শিক্ষকদের কাছেও এ বিষয়ে পুরোপুরি ধারণা নেই বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান বলেন, নতুন কারিকুলামের ধারাবাহিক মূল্যায়ন নিয়ে কোন অস্পষ্টতা নেই। আগে বিভিন্ন ক্লাস টেস্ট হলেও তার কোনো মূল্যায়ন হতো না। এখন সব টেস্টের ধারাবাহিক মূল্যায়ন হচ্ছে। এজন্য বইয়ের ছক এবং শিক্ষকদের জন্য ফরম দেয়া হচ্ছে। তবে সামস্টিক মূল্যায়ন নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। আর এটা ইচ্ছে করেই এখনও শিক্ষকদের জানানো হয়নি। জুনের আগে জানানোর পরিকল্পনা ছিল আমাদের। কারণ, বেশি আগে পদ্ধতি জানিয়ে দিলে সৃজনশীলের মতো এটারও উদ্দেশ্য ব্যহত হতে পারে। আগেই নোট-গাইড বের হয়ে যেতে পারে। তবে এখন এ মূল্যায়ন নিয়ে অনেক হৈচৈ হওয়ায় আমরা হয়তো মে-জুনের আগেই তা শিক্ষকদের জানিয়ে দেব।

তবে মূল্যায়ন সংশ্লিষ্ট একটি অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলেও পরীক্ষামূলক কাজে তাতে ত্রুটি ধরা পড়ায় সঠিকভাবে সেটি প্রস্তুত করতে আরো একবছর লাগবে বলে জানান প্রফেসর মশিউজ্জামান। তিনি বলেন, এই অ্যাপ তৈরি হলে মূল্যায়নের বিভিন্ন যোগ-বিয়োগ ও সংরক্ষণ কাজ সহজ হবে। তবে এটি না হওয়া পর্যন্ত বিকল্প পদ্ধতিতে মূল্যায়ন কাজ অব্যাহত থাকবে।

এছাড়া নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বছর শেষে শিক্ষার্থীদের গতানুগতিক কোনো রোল নম্বর বা জিপিএ নির্ধারণ করা হবে না বলে জানান তিনি। কারণ, রোল নম্বরের প্রথমে থাকা শিক্ষার্থীদের মাঝে একদিকে যেমন অহঙ্কার তৈরি হয়, অন্যদিকে পেছনের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মনোকষ্ট হয়, যা খুব ক্ষতিকর। সব মিলিয়ে নতুন কারিকুলাম নিয়ে কোনো সংশয় নেই এবং এটি নিশ্চিতভাবে সব শ্রেণিতে বাস্তবায়ন হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন এনসিটিবির এই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত