ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সৎকর্মের অন্তত একটি দৃষ্টান্ত রাখুন

সৎকর্মের অন্তত একটি দৃষ্টান্ত রাখুন

মাদ্রাসার ছাত্র জীবনে একটি উর্দু বইয়ে স্বামী-স্ত্রীর একটি ঝগড়ার কথা পড়েছিলাম। ঝগড়ার নায়ক ছিলেন সম্ভবত খলিফা হারুনুর রশীদ ও তার মহীয়সী স্ত্রী জুবাইদা। ঝগড়ায় হঠাৎ যুবাইদা খলিফাকে বলে ফেলেন, আপনি হলেন জাহান্নামি। এত বড় স্পর্ধার জবাবও খলিফা সঙ্গে সঙ্গে দিলেন, আমি জাহান্নামি হলে তোমাকে তিন তালাক। কী জঘন্য ব্যাপার। বাগদাদের মহান খলিফার সংসারে আগুন লাগল। দারুণ উৎকণ্ঠায় বাদশাহ, স্ত্রী জুবাইাদা এবং পুরো মুসলিম জাহান যেন থমকে দাঁড়াল। বড় বড় জ্ঞানীদের কাছে ফতোয়া চাওয়া হলো, খলিফা জাহান্নামি না জান্নাতি। তালাক কি কার্যকরি হয়েছে নাকি হয়নি। খলিফার সংসার টিকবে নাকি টিকবে না। কিন্তু দুনিয়াতে থাকতে কে বলতে পারবে, পরকালে বাদশাহ জান্নাতে যাবেন, নাকি জাহান্নাম তার নসিবে লেখা। কারণ, যে কোনো কাফের শেষ মুহূর্তে ঈমান এনে জান্নাতি হতে পারেন। আবার যে কোনো মুসলমানও ঈমানের সম্পদ হারিয়ে কাফের হয়ে মরতে পারেন।

বিরাট সমাবেশ ডাকা হলো, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা। আলেমরা নিরুত্তর, বিভক্ত। এক তরুণ আলেম এগিয়ে গেলেন। বললেন, এই ফয়সালা আমি দিতে পারব। তবে খলিফাকে আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তার জীবনে কী এমন ঘটনা আছে যে, কোনো পাপ কাজ করতে যাচ্ছিলেন- তবে আল্লাহর কথা স্মরণ আসায় সেখান থেকে বিরত হয়েছেন? কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হয়ে খলিফা হারুনুর রশীদ জবাব দিলেন, হ্যাঁ, আমার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা আছে। তরুণ আলেম ফয়সালা শোনালেন, আপনার স্ত্রীকে দেয়া শর্তযুুক্ত তালাক কার্যকর হয়নি। আলেম সমাজ এমন ফয়সালার পক্ষে দলিল চাইলে তিনি কোরআন মজিদের এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন- ‘যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে এবং নফসের কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’ (সুরা আন-নাযিয়াত : ৪০-৪১)।

সেই তরুণ আলেম ছিলেন ইমাম শাফী (রহ.)। এই ঘটনা প্রমাণ দেয়, আমরা যদি আল্লাহর ভয়ে অন্যায় পথ থেকে ফিরে আসার অন্তত একটি উদাহরণও সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে সফলকাম হতে পারব। এই মর্মে হাদিস শরিফে বর্ণিত আগেকার যুুগের একটি সত্য ঘটনা প্রণিধানযোগ্য।

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি- ‘তোমাদের পূর্বকালের তিনজন লোক কোথাও চলার পথে রাত কাটাবার উদ্দেশে এক পর্বত গুহায় আশ্রয় নিল। তারা সেখানে প্রবেশ করার পর একখানা পাথর খসে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। তারা পরস্পর বলতে লাগল, তোমরা একমাত্র আল্লাহর কাছে তোমাদের খাঁটি আমলকে উসিলা বানিয়ে দোয়া করলে শুধু এই পাথরের বিপদ থেকে মুক্তি পাবে।’ তাদের একজন বলল- হে আল্লাহ! আমার পিতামাতা ছিলেন অত্যধিক বৃদ্ধ। আমি তাদের আমার পরিবার, সন্তান ও অধীনদের (পান করানোর) আগেই দুধ পান করিয়ে দিতাম। একদিন কাঠের সন্ধানে আমাকে বহুদূর যেতে হলো এবং যথাসময়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারলাম না, ফলে তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি তাদের রাতে খাওয়ার জন্য দুধ দোহন করে এনে দেখি তাঁরা ঘুমিয়ে রয়েছেন। তখন তাদের জাগিয়ে তোলা আমি পছন্দ করলাম না। কাজেই আমি দুধের পেয়ালা হাতে নিয়ে তাদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। এদিকে আমার সন্তানগুলোা আমার দুই পায়ের কাছে ক্ষুধায় কান্নাকাটি করছিল। এ অবস্থায় ভোর হয়ে গেল। তারপর তারা জেগে উঠে দুধ পান করেন। হে আল্লাহ! যদি আমি এ কাজটি তোমারই সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি, তাহলে এই পাথরের দরুন আমরা যে বিপদে পড়েছি তা দূর করে দাও। এতে পাথরখানা কিছুটা সরে গেল, কিন্তু তার ফাঁক দিয়ে তারা বের হতে পারল না।

অন্য একজন বলল- হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। আমি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। অন্য বর্ণনায় আছে, পুরুষ নারীকে যত বেশি ভালোবাসতে পারে আমি তাকে তত বেশি ভালোবাসতাম। আমি তার সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলাম। কিন্তু সে রাজি হলো না। শেষে এক দুর্ভিক্ষের বছরে সে আমার কাছে এলে আমি তাকে আমার সঙ্গে নির্জনে মিলনের শর্তে একশত বিশটি স্বর্ণমুদ্রা দিলাম। এতে সে রাজি হয়ে গেল। আমি যখন তাকে পেলাম। এক বর্ণনায় আছে- যখন আমি তার দুই পায়ের মাঝখানে বসলাম, তখন সে বলল- আল্লাহকে ভয় কর এবং অবৈধভাবে আমার কৌমার্য নষ্ট কর না। তখনই আমি তাকে ছেড়ে চলে গেলাম। অথচ মানুষের মধ্যে সে ছিল আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয়। আমি তাকে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলাম তাও ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ তোমারই সন্তোষ লাভের জন্য করে থাকি, তাহলে তুমি আমাদের এই বিপদ দূর করে দাও। এতে পাথর আরো কিছুটা সরে গেল। কিন্তু তাতেও তারা বের হতে পারল না।

তৃতীয় ব্যক্তি বলল- হে আল্লাহ! আমি কয়েকজন মজুর রেখেছিলাম। আমি তাদের সবাইকে মজুরি দিলাম। কিন্তু একজন তার মজুরি রেখে চলে গেল। আমি তার মজুরিটা ব্যবসায়ে খাটালাম। তাতে ধন-দৌলত অনেক বেড়ে গেল।

কিছুকাল পর সে ব্যক্তি আমার কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমার মজুরি দাও। আমি বললাম- এই উট, গরু, ছাগল, চাকর যা তুমি দেখছ সবই তোমার। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা। তুমি আমার সঙ্গে উপহাস করো না। আমি তাকে বললাম- আমি তোমার সঙ্গে উপহাস করছি না। তারপর সে সবকিছু নিয়ে চলে গেল এবং কিছুই রেখে যায়নি। হে আল্লাহ! আমি যদি তোমারই সন্তোষ লাভের জন্য এ কাজ করে থাকি, তবে আমাদের এ বিপদ থেকে মুক্তি দাও। তারপর ওই পাথর সম্পূর্ণ সরে গেল এবং তারা সবাই হেঁটে বের হয়ে গেল। (বোখারি, মুসলিম)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত