ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পবিত্র জীবন গঠনে তাওবার শর্ত

পবিত্র জীবন গঠনে তাওবার শর্ত

তাওবা মানে ফিরে আসা। ফিরে আসার দুটি অর্থ হতে পারে। এক. গোনাহ ও পাপাচার থেকে ফিরে আসা। দুই. আল্লাহর কাছে ফিরে আসা। দুটি অর্থই সঠিক। আল্লাহর কাছে ফিরে আসতে হলে পাপ ও অবাধ্যতার জীবন ছেড়ে আসতে হবে। এই আসার ঘোষণা দিতে হবে আল্লাহর কাছে। খ্রিষ্টধর্মে পাদ্রির কাছে এসে কনফেশন করলে, দোষা স্বীকার করে পাপের স্খলন চাইলে পাদ্রি বা পুরোহিত ক্ষমা করে দিতে পারেন। ইসলামে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে মধ্যস্বত্বভোগী কেউ নেই। কোনো আলেম, পীর বা ধর্মগুরু পাপ মোচন করতে পারেন না। যারা নিজেরা পাপী, তারা কীভাবে অন্যের পাপ মোচন করবেন। পাপ ক্ষমা করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে।

দুনিয়ার জীবনে মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ভুলত্রুটি অন্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এক সময় মনে চিন্তা আসে, পঙ্কিল জীবন ছেড়ে আসার পথ খোঁজে। মাহে রমজানে যখন সবদিকে পবিত্রতার বাতাবরণ তৈরি হয়, এই চেতনা সৌভাগ্যবান মানুষের অন্তরে জাগ্রত হয়। আল্লাহপাক এমন বান্দাদের ডাক দিয়ে বলেন, তোমরা ফিরে এসো আমার কাছে। আমার রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় নাও। কোরআন মজিদে এরশাদ হয়েছে ঃ

‘এবং যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেলে অথবা নিজেদের প্রতি অবিচার করে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ব্যতীত কে পাপ ক্ষমা করবে। এবং তারা যা করে ফেলে জেনে শুনে তারই পুনরাবৃত্তি করে না। এরাই সেই লোক যাদের পুরস্কার হলো আপন প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং জান্নাত, যার পাদদেশে নদীগুলো প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করবে এবং সৎকর্মশীলদের

পুরস্কার কতই না উত্তম।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৫-১৩৬)।

আল্লাহর কাছে ফিরে আসা বুঝার সহজ উপমা হতে পারে নেটওয়ার্ক। কয়েক বছর আগে পঞ্চগড় গিয়েছিলাম কয়েকজন পুরোনো বন্ধুর সাক্ষাতে। দেখি হাতের মোবাইলটি কথা বলছে না। জানানো হলো, এখানে এখনো গ্রামীণ ফোনের নেটওয়ার্ক আসেনি। ফেরার পথে বগুড়া এলে মোবাইল ফোন সচল হয়ে ওঠে। বুঝতে পারলাম, মোবাইল ফোনসেট নেটওয়ার্কের আওতায় চলে এসেছে। সব কিছু থাকলেও নেটওয়ার্ক না থাকলে অন্তর্গত যোগাযোগ অসম্ভব।

সৃষ্টির সর্বত্র আল্লাহতায়ালার অসীম কুদরত, রহমত ও জ্ঞানের বিশালতা বিরাজিত। তার সঙ্গে বান্দার সংযোগ প্রতিষ্ঠার নেটওয়ার্ক ঈমান, বিশ্বাস। বিশ্বাসের সূত্রে আল্লাহর সঙ্গে ঈমানদার বান্দা ভয় ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ। বান্দা যখন পাপ কাজে লিপ্ত হয় বা আল্লাহকে ভুলে যায়, তখন সে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যায়। ঊর্ধ্বজগতের সঙ্গে তার কলবের মোবাইল সেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

একাধিক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- ‘কোনো মোমিন যে মুহূর্তে কোনো ব্যভিচার লিপ্ত হয় তখন সে মোমিন থাকে না। যে মুহূর্তে চুরি করে তখন ঈমানের সঙ্গে তার বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। যখন সন্ত্রাস, ছিনতাই ও ডাকাতি করে, তখনও সে ঈমানের বন্ধনের বাইরে চলে যায়। পাপ কাজ থেকে বিরত হওয়ার পর ঈমান আবার ফিরে আসে। অর্থাৎ ঈমানের নেটওয়ার্ক আবার পুনঃস্থাপিত হয়। এ জন্যই ইসলাম শিক্ষা দেয়, মোমিন মুসলমানকে সবসময় আল্লাহর রহমত, অসীম জ্ঞান ও ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে অবস্থান করতে হবে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন ও আল্লাহকে স্মরণে রাখতে হবে। কোনো পাপকাজ অন্যায় অশ্লীলতার কারণে যদি সেই বলয় থেকে সাময়িক বিচ্যুতি ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে ভুল স্বীকার করে ফিরে আসতে হবে। ফিরে আসতে হবে পাপের পথ থেকে। ফিরে আসতে হবে আল্লাহর কাছে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সৎকর্মের বলয়ের মধ্যে আশ্রয় নিতে হবে। এই ফিরে আসাই তাওবা এবং তাওবার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। রিয়াদুস সালেহিন প্রণেতা ইমাম নববি (রহ.) বলেছেন-

ওলামায়ে কেরামের মত হলো, যে কোনো গোনাহ থেকে তাওবা করা ওয়াজিব। যদি গোনাহ আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার বিষয় সংশ্লিষ্ট হয় এবং তার সঙ্গে কোনো লোকের অধিকারের বিষয় জড়িত না থাকে, তবে তা থেকে তাওবা করার তিনটি শর্ত রয়েছে।

এক. তাওবাকারীকে সেই গোনাহ থেকে বিরত হতে হবে।

দুই. গোনাহের কাজটির জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে।

তিন. আর কখনো এই গোনাহের কাজে ফিরবে না মর্র্মে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে।

অর্থাৎ পাপ বর্জন, অতীত পাপের জন্য অনুশোচনা এবং ভবিষ্যতে এই কাজ করবে না বলে দৃৃঢ় সিদ্ধান্ত থাকতে হবে।

গোনাহের কাজটি যদি কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে তাওবা শুদ্ধ হওয়ার জন্য উপরোক্ত তিনটি শর্ত ছাড়াও আরো একটি শর্ত আছে।

চার. তাওবাকারীকে হকদার ব্যক্তির পাওনা আদায় করে দিতে হবে। যদি কারো ধন-সম্পত্তির হক থাকে অথবা এরূপ অন্য কিছু থাকে, তবে তা তাকে ফেরত দিতে হবে। কারো সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার মতো কোনো বিষয় থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে তার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে অথবা তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।

কারো গিবত বা পরনিন্দা কিংবা কথায় আচরণে কারো মানহানির মতো কোনো ব্যাপার থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিতে হবে। তাওবা সব গোনাহ থেকে করতে হবে। অবশ্য কতক গোনাহ থেকে তাওবা করলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে। তবে অন্যান্য গোনাহ থেকে তাওবার বাধ্যবাধকতা রয়ে যাবে।

হাদিসের ভাষায় যে ব্যক্তি রমজান পেল অথচ তার গোনাহগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারল না, সে বড়ই হতভাগা। আল্লাহতায়ালার নাফরমানি করলে তিনি তাওবা করলে মাফ করে দেবেন। কিন্তু বান্দার হক তিনি মাফ করবেন না, এটা তার বিধানে নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকেই দায়মুক্ত হতে হবে। যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপির তালিকায় নাম লেখান, তারা অগণিত মানুষের হক কীভাবে শোধ করবেন, কী উপায় হবে। আল্লাহপাক সবাইকে হেফাজত করুন, কবুল করুন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত