আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ার সহজ পথ

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

যারা সৎ, ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক- লোকসমাজে সবার মাঝে তাদের সমাদর। অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা, নাম-যশে বড় না হলেও মনের দিক দিয়ে সবাই তাদের ভালোবাসে। এ ধরনের লোক স্বভাবতই আল্লাহর কাছেও প্রিয়ভাজন হয়। তাদের বিপরীতে সমাজে এমন কিছু লোক আছে যারা অধার্মিক। পাপতাপে, অন্যায় অসত্য, অসুন্দরের পথে চলতে চলতে বিপথগামী।

মাহে রমজানে সর্বত্র যখন পবিত্রতা ও সৎ-সুন্দর চেতনার আবহ সৃষ্টি হয়, বিপথগামী লোকদের মধ্যে যাদের কপাল ভালো তাদের সামনে আত্ম উপলব্ধির দুয়ার খুলে যায়। জীবনকে নতুন করে সাজানোর তাগাদা অনুভব করে। কিন্তু সহজে পথ খুঁজে পায় না। জীবনে এত পাপ, অন্যায় করেছি, আমার মুক্তির কোনো পথ কী আছে, থাকতে পারে। হ্যাঁ তাদের জন্য এবং সবার জন্য এমন একটি পথ আছে যা শুধু গোনাহমুক্তি নয়, একেবারে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ার পথ দেখায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পাপী-নেককার, ধার্মিক-অধার্মিক সবাইকে এই একটি পথ আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যায়। বিষয়টি বোধগম্য হওয়ার জন্য একটি ছোট্ট উদাহরণের কথা চিন্তা করতে পারি।

অভিজাত ঘরের একমাত্র শিক্ষিত ছেলেটি বখে গেল। মা-বাবার তখন দুশ্চিন্তা আর হতাশার অন্ত থাকে না। এক সময় বখাটেদের খপ্পরে পড়ে ছেলে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ল। তখন মা-বাবার চোখে সমগ্র দুনিয়াই অন্ধকার হয়ে যায়। তাদের রাতদিনের কান্না আল্লাহর রহমতে রূপান্তরিত হয়ে একদিন যখন দেখে, প্রাণের ধন ছেলেটির জীবনে আমূল পরিবর্তন। সৎ, সুন্দর ধার্মিক জীবনে ফিরে এসেছে। এবং মা-বাবার সহায় সম্পদ দেখাশুনা করছে তখন মা বাবার খুশির সীমা থাকে না।

অসৎ পথ থেকে ভালো পথে ফিরে আসা এবং জীবনের গতি পরিবর্তনকে ধর্মীয় পরিভাষায় বলা হয় তাওবা। মানুষ যখন ইস্তিগফার বা আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফ চায়, আল্লাহর কাছে ফিরে আসার বাসনায় অতীতের পাপের জীবন ছেড়ে তাওবা করে, তখন আল্লাহপাক বান্দার সব গোনাহ মাফ করে দেন। তাকে একান্ত প্রিয়ভাজন হিসেবে গ্রহণ করেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত, ‘গোনাহখাতা থেকে যে তাওবা করে, তার অবস্থা হয় তার যেন কোনো গোনাহ নেই।’ কারণ, তাওবা অতীতের সব গোনাহ ধ্বংস করে দেয়।

শুধু গোনাহগার নয়, আল্লাহর নেক বান্দাদের কাছেও আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ার সহজ পথ তাওবা ও ইস্তিগফার। তাওবা মানে পাপের পথ ছেড়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা আর ইস্তিগফার মানে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কৃত পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এ কাজটির হাকিকত এতই গভীর যে, স্বয়ং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- যার জীবনে কোনো গোনাহ ছিল না, যিনি ছিলেন মাসুম নিষ্পাপ, যার অতীত ভবিষ্যতের সব গোনাহ আল্লাহতায়ালা মার্জনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি দিনে ৭০ বার আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করি। তিনি আরো বলেছেন : হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা, আমি দৈনিক শতবার তাওবা করি।’ (মুসলিম)।

নবীজির এই ইস্তিগফারের তাৎপর্য বুঝতে না পারার কারণে অপরিচ্ছন্ন মনের লোকেরা বিভ্রান্তির শিকার হয়। নবীজির সার্বক্ষণিক মনোসংযোগ আল্লাহর নিকে নিবেদিত থাকে। কোনো কারণে যদি এই মনোযোগ অন্যদিকে হয়ে থাকত, তার জন্যও তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন। এই ক্ষমা চাওয়া সাধারণ অর্থে গোনাহ মার্জনার জন্য নয়। নবীজির অনুকরণে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা যত বেশি আল্লাহর বেশি কাছের, তারা তত বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করতেন। কারণ, আধ্যাত্মিক পদমর্যাদ বৃদ্ধির জন্য এটি অতি সহজ একটি পথ।

কোনো শহরে প্রবেশের বিভিন্ন পথ থাকতে পারে। এর মধ্যে একটি পথ থাকে তুলনামূলকভাবে সহজ। তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছার যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগামী হচ্ছে বিমান। অসৎ ও অসুন্দরের পথ ছেড়ে আসার এবং আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ ও বাহনও হচ্ছে তাওবা ও ইস্তিগফার।

মানুষ যখন এই পথ ধরে অগ্রসর হয়, তখন মানুষের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার আনন্দ, বখে যাওয়া একমাত্র ছেলে সৎপথে আসায় মা-বাবার আনন্দকেও ছাড়িয়ে যায়। বিষয়টি মানুষের বোধ ও উপলব্ধির নিকটবর্তী করার জন্য স্বয়ং নবী করিম (সা.) একটি উদাহরণ দিয়েছেন, যা বোখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত। আমরা সরাসরি হাদিসটির অনুবাদ পেশ করছি।

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম আবু হামযা আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবায় তোমাদের ওই ব্যক্তির চেয়েও বেশি আনন্দিত হন, যার উট মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়ার পর সে তা ফিরে পেল।’ (বোখারি ও মুসলিমের বরাতে রিয়াদুস সালেহীন)।

ইমাম মুসলিমের অপর বর্ণনায় বিষয়টি আরো বিস্তারিতভাবে এসেছে। ‘আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবায় তোমাদের ওই ব্যক্তির চেয়েও বেশি আনন্দিত হন, যার খাদ্য ও পানীয়সহ তার উট মরুভূমিতে হারিয়ে গেল। সে (জীবনে বেঁচে থাকার ব্যাপারে) নিরাশ হয়ে এক গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ল। এহেন নিরাশ অবস্থায় হঠাৎ (চোখ মেলে) তার কাছে উটটিকে দাঁড়ানো দেখতে পেয়ে সে তার লাগাম ধরে ফেলল এবং আনন্দের আতিশয্যে বলে উঠল, হে আল্লাহ তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার প্রভু। সে আনন্দের আতিশয্যে ভুল করে ফেলেছে।’ (মুসলিম)।

আসুন আমরা নিজেকে শুধরে নিই। অতীতে কোনো অন্যায় করে থাকলে তার জন্য অনুতপ্ত হই। অন্যায় কাজটি এ মুহূর্তে মন থেকে বর্জন করি। ভবিষ্যতে এমন কাজ করব না বলে আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা করি। কারো হক নষ্ট করে থাকলে তার ক্ষতিপূরণ করি। আল্লাহর সাহায্য চাই। তাহলে আল্লাহর দয়া ও রহমত আমাদের ওপর ছায়াপাত করবে। আল্লাহর প্রিয়ভাজনদের মজলিসে শামিল হওয়ার সৌভাগ্য নসিব হবে।