স্যার না ভাই কোনটা সঠিক

স্পষ্ট নীতিমালার অভাবে বাড়ছে মানসিক দ্বন্দ্ব

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দেশজুড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করায় বছরের পর বছর বিতর্ক চলছেই। স্যার সম্বোধনের ইস্যুতে জনগণ, সেবাগ্রহীতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রায় দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। এমনকি স্যার সম্বোধন না করায় জনগণের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন কিছু সরকারি কর্মকর্তা। স্যার শব্দ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, ইউটিউব ও গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। এরপরও ‘স্যার’ শব্দের সুনির্দিষ্ট সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সাবেক আমলা ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের উচিত এ ব্যাপারে নীতিমালা করে দেয়া। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তারা ‘স্যার’ সম্বোধন আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। প্রশাসন ক্যাডার থেকে শুরু করে বেশকিছু চিকিৎসকের মধ্যে ‘স্যার’ প্রীতি ভর করেছে। বহু আগেই সরকারি কিছু কর্মকর্তা নির্ধারিত সাংবিধানিক এবং আইনি চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে ক্ষমতার চর্চা করে আসছেন। কলোনিমুক্ত হলেও কর্মকর্তাদের ভেতর কলোনিয়াল অভ্যাস চলেছে। যা গত কয়েক বছরে এই প্রবণতা বেড়েছে। সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ না হয়, সেজন্য তারা এখন জনগণের কর্তা সেজে বসেছেন। জানা গেছে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় জনগণ বা সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ বিধিমালা-১৯৭৯ সালে করা হয়েছিল। ২০০২ ও ২০১১ সালে দুই দফায় এই বিধিমালা সংশোধন করা হয়। ২০১৪ সালে আরেকবার এই বিধিমালা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। তবে গত ৯ বছরে বিধিমালার খসড়া তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। যা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই খসড়ায়ও সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে আচরণ বা সম্বোধনের বিষয়ে কিছু বলা নেই।

বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আমলারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন এবং জনগণকে সেবা দেন। কিন্তু একজন আমলাকে কি বলে সেবাগ্রহীতা সম্বোধন করবেন তা সুস্পষ্ট নেই। সেজন্য বিভিন্ন সময়ে স্যার ও ভাই বলে সম্বোধন করা হয়। যা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও প্রশিক্ষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সহিদউল্যাহ বলেন, নাগরিকরা সেবা নিতে এলে কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবেন এবং সম্মান করবেন, সেই বিষয়ে ছয় মাসের জন্য কর্মকর্তাদের ফাউন্ডেশন কোর্স করা হয়। এরপরও কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে। সেজন্য রিফ্রেশার কোর্স চালু করতে হবে।

১৯৯০ সালে জারি করা তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। যেখানে বলা আছে, মৌখিক সম্বোধনে পুরুষের ক্ষেত্রে ‘স্যার’ ও নারীদের ক্ষেত্রে ‘ম্যাডাম’ ব্যবহার করা যেতে পারে; কিন্তু আদেশ কার বেলায়, কোথায়, কীভাবে কার্যকর হবে, এ বিষয়ে কিছু বলা নেই।

সরকারি কর্মকর্তাদের স্যার সম্বোধনের বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, বিদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের নাম ধরে ডাকে (নাগরিকরা)। এ দেশেও এ সংস্কৃতি শুরু করে সবাইকে নাম ধরে ডাকা উচিত। এটাই আন্তর্জাতিক চর্চা। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এ সমস্যার সমাধান হবে।

সরকারি কর্মকর্তাদের স্যার ডাকার ইস্যু নিয়ে ২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেসে এক প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরদার হোসেন বলেছিলেন, ‘একজন কর্মকর্তার আচরণের মধ্য দিয়ে সরকারের আচরণ প্রকাশ পায়। আপনার আচরণ সরকারের আচরণ। আপনার আচরণ, আপনার অফিস, সাধারণ মানুষ মনে করে, এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একটি অংশ। অতএব, সে ক্ষেত্রে যাতে করে আমাদের কর্মকর্তারা এটি অবশ্যই মেনে চলে। স্যার, ম্যাডাম বা এমন কিছু বলে সম্বোধন করতে হবে, এমন কোনো রীতি নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ ডাকার কোনো নিয়ম নেই। রেগে কথা বলা, তিরস্কার বা দুর্ব্যবহার দুর্নীতির শামিল।’ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পরও বিভিন্ন সময়ে সারা দেশে স্যার সম্বোধন না করায় জনগণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন কিছু আমলা।

বছরের পর বছর স্যার সম্বোধন নিয়ে প্রশাসনের মধ্যে এক ধরনের দাম্ভিকতা দেখা যায়। সর্বশেষ গত ২২ মার্চ রংপুরের জেলা প্রশাসককে স্যার বলতে বাধ্য করার অভিযোগ করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। এ ঘটনার প্রতিবাদে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক তাৎক্ষণিকভাবে মেয়েকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন। পরে জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন কার্যালয় থেকে নেমে এসে দুঃখ প্রকাশ করলে বিষয়টির সেখানে ইতি ঘটে। এ ঘটনার রেষ শেষ হতে না হতেই গতকাল মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক নারী চিকিৎসককে স্থানীয় এক সাংবাদিক ‘আপা’ ডাকলে ক্ষিপ্ত হয়ে ‘ম্যাডাম’ ডাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ওই চিকিৎসকের নাম নিরুপমা পাল। তিনি ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইউএইচএফপিও পদে কর্মরত আছেন। চিকিৎসকের এমন আচরণে বিব্রত মানিকগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জনও। বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে জানিয়ে সিভিল সার্জন মোয়াজ্জেম আলী চৌধুরী জানান, ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

স্যার সম্বোধন নিয়ে ২০২১ সালের ৩০ মে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাস এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকরা তাকে ভাই বলায় বিরক্ত হন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের ভাই বলে ডাকার রেওয়াজ আর গেল না, জানেন আমাদের এই চেয়ারে বসতে কত কষ্ট করতে হয়েছে?’ এপ্রিলে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলায় ইউএনওকে স্যার না বলায় থানার ওসি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে হেনস্তা করেন। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামুন খানকে সাংবাদিক আশিক জামান ফোনে তথ্য নিতে গিয়ে ভাই বলায় তিনি খেপে যান। এসিল্যান্ড সাংবাদিককে তথ্য না দিয়ে বলেন, ‘তার আগে বলেন, আপনি এসিল্যান্ডকে ভাই কেন বলছেন, আমি আপনার কেমন ভাই।’ স্যার ডাকলে তিনি খুশি কি না ওই সাংবাদিক জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না না, আপনার স্যার ডাকতে হবে না। কিন্তু কখনো ভাই ডাকবেন না। এটা ফরমাল কোনো ডেকোরাম না।’

বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ একটি নীতি আছে। সেটা প্রশাসনের জন্য প্রযোজ্য। আমরা প্রশাসনে নিজেদের মধ্যে যখন অফিশিয়াল চিঠি লিখি, যোগাযোগ করি তখন কাকে কীভাবে সম্বোধন করব, তবে এটা জনগণের জন্য নয়। স্যার বলা বা বলতে বাধ্য করানো ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা’। সম্মানের বিষয়টি পারস্পরিক, তা জোর করে আদায় করা যায় না।’ সাধারণ মানুষ সরকারি কর্মচারীদের কীভাবে সম্বোধন করবেন সেই বিভ্রান্তি দূর করতে সরকারের নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন শেখ ইউসুফ হারুন।