ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ধৈর্যের বর্মে সজ্জিত হওয়ার সাধনা

ধৈর্যের বর্মে সজ্জিত হওয়ার সাধনা

‘ওয়াহুয়া শাহরুস সাবরি, ওয়াস সাবরু সাওয়াবুহুল জান্নাহ’, ‘রমজান মাস ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের প্রতিদান হলো জান্নাত।’ হজরত নবী করিম (সা.)-এর পবিত্র জবানে রমজানের এই বৈশিষ্ট্যের কথা ব্যক্ত হয়েছে। ধৈর্য কী? রমজানকে কেন ধৈর্যের মাস হিসেবে চিহ্নিত করলেন স্বয়ং নবীজি।

লক্ষ অর্জনের পথে যে কোনো বাধা, ক্ষয়ক্ষতি অতিক্রম করা, বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরও লক্ষ অর্জনের জন্য অদম্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার নাম ধৈর্য। আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি তোমাদের কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের- যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। এরাই সেই লোক, যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়, আর এরাই সৎপথে পরিচালিত।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭)।

সাধারণত কোনো বিপদ আপদ বা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলে আমরা মনে করি আল্লাহপাক আমার প্রতি নারাজ হয়েছেন। কিন্তু না। আয়াতে বলা হয়েছে, বিপদ আপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। স্কুল-মাদ্রাসায় যারা লেখাপড়ায় ভালো তারাই পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি পায়। এখানেও যারা আল্লাহর প্রিয়ভাজন, তাদেরই আল্লাহ পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। যারা আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে, তারাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করে এবং তারাই হেদায়তপ্রাপ্ত।

পরীক্ষা হয় পদোন্নতির জন্য। আল্লাহপাক বান্দাকে ধৈর্যের পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। বিনিময়ে পদোন্নতি দেন। হাদিসের ভাষায় এই পদোন্নতি হলো জান্নাত লাভ। কোরআন মজিদের একাধিক আয়াতে ধৈর্যের প্রসঙ্গ এসেছে। তাতে এতটুকুন বলেই শেষ করা হয়নি যে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন, তাদের ওপর রহমত নাজিল করেন, তাদের সাহায্য করেন। বরং বলা হয়েছে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। কোরআন মজিদে এরশাদ হয়েছে : ‘হে মুমিনরা তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য কামনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা বাকারা : ১৫৩)।

আমরা জীবনভর ধৈর্যের মহিমা শুনে আসছি নানা সূত্র থেকে। কিন্তু বিপদ যখন আসে, পরিস্থিতি যখন আমার ইচ্ছার বিপরীত চলে যায়, ধৈর্য ধারণ করতে পারি না, খেই হারিয়ে ফেলি। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষমতা থাকে না। এর কারণ হলো, ধৈর্যের গুরুত্ব জানা, স্বীকার করা ও মুখে চর্চার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবে তার অনুশীলন হতে হবে। যাতে ধৈর্য আমাদের আত্মস্থ, মজ্জাগত ও স্বভাবের অংশ হয়ে যায়। তাহলেই কোনো অবস্থাতে ধৈর্যের লাগাম হাতছাড়া হবে না। তখন মনের অজান্তে কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্য এসে ঢাল-সড়কি ও বর্ম হয়ে সামনে হাজির হবে। এই গুণ অর্জনের জন্য এক দুই দিনের অনুশীলন যথেষ্ট নয়। একটানা একমাস সাধনার জাঁতাকলে স্বভাবের সঙ্গে ঝালাই ঢালাই করে নিতে হবে। নবী করিম (সা.) রমজানকে ধৈর্যের মাস বলার তাৎপর্য এখানেই নিহিত।

কয়েক বছর আগে রমজান মাসে একজন রিকশাওয়ালার কথা বারবার মনে পড়ে। গন্তব্যে পৌঁছার তাড়া ছিল। দ্রুত দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল। রিকশার ধীরগতির কারণে বিরক্তির সুরে বললাম, একটু তাড়াতাড়ি টানেন না ভাই। রিকশাওয়ালা কৈফিয়তের সুরে বলল, সকালের দিকটা ভালোই টেনেছি। বেলা পড়ে যাওয়ায় ক্লান্ত শরীরে আর টানতে পারছি না। বুঝতে পারলাম, ভদ্রলোক রোজা রেখে পেটের দায়ে রিকশা টানছেন। মনে মনে লজ্জিত হলাম। ভাবলাম, আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসায় পরিশ্রমি লোকেরা কীভাবে যে ধৈর্যের পরীক্ষা দেন। হাদিসের ভাষায় ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাতের সুসংবাদ তো এমন খেটে খাওয়া মানুষদের জন্যই।

রোজা রেখে অনেকের ক্ষুধায় পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় এরপরও দিনের বেলা লোকচক্ষুর আড়ালে খায় না একমুঠো খাবার। গ্রীষ্মের তাপদাহে কৃষক পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে শরীর জুড়ায়। কিন্তু ডুব দিয়ে এক চুমুক পানি মুখে প্রবেশ করতে দেয় না। বিদেশগামী স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় একা। এর পরও দিনের বেলা আল্লাহর বাধা লঙ্ঘন করে না তারা। জৈবিক চাহিদা ও কামনার মোকাবিলায় ধৈর্যের কেমন পরীক্ষা ও অনুশীলন। সত্যিই মানব চরিত্র ও স্বভাবের সঙ্গে ধৈর্যের বৈশিষ্ট্য একাত্ম একাকার করে দেয়ার জন্য রমজানের রোজার চেয়ে উত্তম সাধনার নজির কোথাও নেই। এখানেই ইসলামের বৈশিষ্ট্য।

অনেকে মনে করি, দিনের বেলা পানাহার ও যৌন সংসর্গ থেকে বিরত থাকলেই রোজা হয়ে গেল। কিন্তু না। এটি রোজার বাহ্যিক রূপ, ন্যূনতম শর্ত। রোজা সহিশুদ্ধ হওয়ার জন্য সব ধরনের অশ্লীলতা, গালমন্দ, ঝগড়া, মানুষের সঙ্গে রূঢ় আচরণ পরিহার করতে হবে।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন : তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রোজা রাখে সে যেন অশ্লীল বাক্যালাপ বা গালমন্দ না করে। যদি কেউ গালমন্দ করে অথবা ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে আমি একজন রোজাদার। (তোমার ঝগড়া বা গালমন্দের জবাব দিতে অপারগ) (মিশকাত)।

হাদিসের শিক্ষা লক্ষ্য করুন। নিজে তো ঝগড়া বা গালমন্দ থেকে বিরত থাকবেই, যদি কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে চায়, গালমন্দ করে- তারও কোনো জবাব দিতে পারবে না। বরং ভদ্রতার সঙ্গে সেখান থেকে চলে আসবে। নিজের অপারগতা স্বীকার করে নেবে।

বস্তুত ব্যক্তিচরিত্রকে ধৈর্যের বর্মে সজ্জিত করার জন্যই রমজানের সাধনা। এ জন্যই নবীজি বলেছেন, রমজান ধৈর্যের মাস। কারণ, ধৈর্য মানব জীবনে উন্নতি অগ্রগতির নিয়ামক। অনেকে কর্মজীবনে ব্যর্থ বা মার খাওয়ার পর দমে যান। কিন্তু যারা বিরূপ পরিস্থিতির কাছে হার না মেনে লক্ষ অর্জনের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন তারা এক সময় বলেন, ওই দিনের বিপদটা আসার কারণে বা ব্যবসায়ে কিংবা কর্মজীবনে ব্যর্থ হওয়ার কল্যাণেই জীবনে এত বড় সাফল্য এসেছে। আলহামদুলিল্লাহ।

কাজেই ইসলামের শিক্ষা হলো, কোনো অবস্থাতেই ধৈর্র্য হাতছাড়া না করা। আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া। শেখ সাদী (রহ.) বলেছেন, ‘খোদা গর যে হেকমত বেবন্দদ দরি/গুশায়দ যে রহমত দরে দিগরি।’ ‘আল্লাহ যদি কোনো হিকমত বা বান্দার কল্যাণ চিন্তার কারণে কোনো একটি দরজা বন্ধ করে দেন। তাহলে আপন রহমত হেতু আরেকটি দরজা খুলে দেন।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত