ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আল্লাহর রহমতের বিশালতা

আল্লাহর রহমতের বিশালতা

গভীর সমুদ্রে মহাসম্মেলন। তরুণ পণ্ডিত এক মাছ বক্তৃতায় বলল, আমরা মৎস্যজাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত একটি প্রশ্নে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, আমাদের অস্তিত্ব টিকে আছে পানির ওপর। কিন্তু পানির দেখা পেলাম না কোনোদিন। পরস্পর কানাকানি শুরু হলো। জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হলো বিষয়টি। প্রত্যেকে একমত, জীবনভর শুনে আসলাম পানি নামে একটি জিনিস আছে সর্বত্র বিরাজিত, যার ওপর আমাদের অস্তিত্ব টিকে আছে। কিন্তুপানির দেখা পেলাম না কখনো। জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, পানির সাক্ষাৎ পেতে হবে। তাহলেই আমাদের জীবন সার্থক হবে। অন্যথায় এই জনম অনর্থক। এক প্রাজ্ঞ মাছ জানাল, অমুক মহাসাগরে এক দিব্যজ্ঞানী বৃদ্ধ মাছ আছে, মৎস্য জগতের পীর। তিনি বলে দিতে পারেন পানির হাকিকত, আমাদের জীবনের রহস্য। শুরু হলো দীর্ঘ সফর। পথে অনেকে মারা পড়ল, হারিয়ে গেল নানা কারণে। অবশেষে একটি ছোট্ট দল দিব্যজ্ঞানী পীরমাছের সাক্ষাতে পৌঁছল। তার কাছে তাদের প্রশ্ন, হাকিকতের সন্ধানে দীর্ঘ সফরের দুঃখ-দুর্দশার কথাও জানাল। বৃদ্ধ মাছ তাদের কাছে জানতে চাইল, বল তো যে সাগরে তোমাদের বিচরণ, জীবনযাপন তাতে পানি ছাড়া আছে কী? এই প্রশ্ন মাছেদের দিব্যচক্ষু খুলে দিল।

হ্যাঁ, আমরা জীবনভর শুনে আসছি সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজিত আল্লাহর রহমতের ওপর টিকে আছে আমাদের জীবন; কিন্তু কখনো তো দেখলাম না এই রহমত কী।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওয়া রাহমাতি ওয়াসেআত কুল্লা শাইয়িন’- ‘আমার রহমত প্রসারিত আছে প্রত্যেক জিনিসে।’ (সুরা আরাফ : ১৫৬)। আল্লাহর রহমতের উপাদান মিশে আছে পানিতে। তাই পানি সৃষ্টজীবের প্রাণবর্ধক। যখন রহমতের উপাদান হ্রাস পেয়ে গজবের (গোস্বা) উপাদান প্রবল হয়, তখন সেই পানি প্রাণসংহারক হয়ে যায়। সাগর রোষে ফুঁসে ওঠে। বন্যা প্লাবনের তাণ্ডব শুরু হয়। আগুনে রহমতের উপাদান যতক্ষণ প্রবল থাকে আগুন রান্নাবান্না জোগান দেয়, মানুষের খেদমতে নিয়োজিত থাকে। রহমতের উপাদান হ্রাস পেলে অগ্নিকাণ্ডের লেলিহান শিখা দাউদাউ করে ওঠে। অনুরূপ ফুলের চারায় রহমতের ছোঁয়া লাগে, ফুল ফোটে। বসন্তে বিশ্ব প্রকৃতিতে প্রাণের শিহরণ জাগায়। রহমতের পরশে সৃষ্টির সর্বত্র প্রাণের তরঙ্গ।

রহমতের আম খাস দুটি প্রকরণ আছে। আম রহমতে কাফের মুশরিক ভালো-মন্দ সবাই সমান পরশ পায়। খাস রহমতের সঙ্গে যুক্ত আছে হেদায়াত, সৎপথে চলার তৌফিক সামর্থ্য। রহমতের এই প্রকরণটি শুধু ঈমানদার, সৎপথের অনুসারীরাই পায়।

বিশ্বপ্রকৃতিতে কখনো বসন্তের মলয় সুবাসে প্রাণ জুড়ায়, কখনো আশ্বিনের মৃদুমন্দ হাওয়ায় সোনালি ধানের মাঠ দোল খায়। নবীজি (সা.) বলেছেন, রমজানের প্রথম দশক রহমত, মধ্যের ১০ দিন মাগফিরাত এবং শেষ ১০ দিন নাজাত।

হাদিস শরিফের ভাষায় রহমতের পরিচয় এভাবে পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন-

‘আল্লাহতায়ালার একশটি রহমত আছে। তা থেকে একটি রহমত তিনি সাত আসমান ও সাত তবকা জমিনে প্রেরণ করেছেন : অতঃপর তা আপন সৃষ্টির মাঝে বণ্টন করে দিয়েছেন। এই একটি রহমতের বদৌলতে সৃষ্টিলোকের সবাই একে অপরকে ভালোবাসে, পরস্পরে দয়া-অনুগ্রহ দেখায়। বাকি নিরানব্বইটি রহমত তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। কেয়ামতের দিন তিনি এই একটি রহমতও নিজের কাছে ফিরিয়ে নেবেন। তাতে একশটি রহমত পূর্ণ হবে। তখন শিরককারীদের মোমিনদের থেকে আলাদা করা হবে, আর সব রহমত দেয়া হবে মোমিনদের।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

এখানে আম ও খাস রহমতের বিবরণ সুস্পষ্ট। যে রহমতের পরশে আল্লাহর নেক বান্দা, ঈমানদাররা ঈমান ও ইসলামের সৌভাগ্য লাভ করেছে, সে রহমত থেকে কাফের মুশরিক অবাধ্যরা বঞ্চিত।

আম রহমত দুনিয়াতে সবার জন্য সমান এবং তার নিদর্শন দৃশ্যমান হলেও খাস রহমত চোখে দেখা যায় না। এর ছোঁয়ায় রমজানে মোমিন বান্দার অন্তরে অন্তরে ইবাদত-বন্দেগির শিহরণ জাগে। গরিব-দুঃখীর প্রতি দরদ তাদের অন্তর ছুঁয়ে যায়। এই রহমতের ছোঁয়াতেই সারাদিন রোজা আর ইফতারের পর ক্লান্ত শরীরে গভীর রাতে দেড় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মসজিদে তারাবির জামাতে শরিক হওয়ার শক্তি পায়।

প্রশ্ন আসে, মাহে রমজানের অফুরান রহমতের ছোঁয়া কীভাবে পাওয়া সম্ভব হবে। এই প্রশ্নের জবাবের মধ্যে আরো একটি জটিল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে। তা হলো, রমজানে আল্লাহর রহমতের ঢেউ তরঙ্গের মধ্যেও কতক লোক অবাধ্য থাকে কীভাবে। কীভাবে মুসলমান ঘরের সন্তান হয়েও নামাজ রোজার তাগাদা অনুভব করে না? তাছাড়া কাফের মুশরিক বেদ্বীনদের বিশাল জগৎ তো আছেই। এর সহজ জবাব, যারা আল্লাহর রহমত পেতে চায়, তাদের মনে এই রহমত সৎ পথে চলার প্রেরণ জোগায়, পথ দেখায়। ঘাড় ধরে সৎপথে চলতে বাধ্য করে না। এটিই আল্লাহর শাশ্বত নিয়ম।

বর্ষায় অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। চারদিকে পানি থই থই করে। এরপরও সটান পাথরের ভেতর বৃষ্টির পানি প্রবেশ করতে পারে না। যেখানে গর্ত আছে, পানি ধরে রাখতে পারে, পুকুর, খালবিল মাটির নরম শরীর সেখানে বৃষ্টির পানি অবদান রাখে, প্রাণের শিহরণ জাগায়। আল্লাহর রহমত পেতে হলেও দিলের জমিন প্রস্তুত করা চাই। হৃদয়ের পাত্রটি তুলে ধরতে হবে ঊর্ধ্ব আকাশ পানে। মহাগ্রন্থ কোরআন সম্বন্ধেও আল্লাহপাক বলেছেন, এই কিতাব মুত্তাকিদের হেদায়তের জন্য। রমজানের প্রধান বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারেও বলা হয়েছে, রোজা পালনের মাধ্যমে যাতে তোমরা তাকওয়ার জীবন লাভ করতে পারে। কাজেই চাইতে হবে। তাকওয়ার জীবনের সন্ধানী হতে হবে। যারা চায় না, তারা পায় না। চাওয়ার পথ তাওবা। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, ইস্তিগফার। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মান্য করা। বিশেষ করে নিজের অহমিকার দেমাগ নামিয়ে রাখা। দিব্যজ্ঞানী মওলানা রুমি (রহ.) বলেন,

সালহা তো সঙ্গ বূদী দিল খরাশ

আযেমূন রা এক জমানা খাক বাশ

বহু বছর তুমি পাথর ছিলে হৃদয়বিদারক

একটিবার এবার মাটি হয়ে দেখ পরীক্ষামূলক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত