ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নবীজির ভালোবাসায় আলোকিত হোক হৃদয়প্রান্তর

নবীজির ভালোবাসায় আলোকিত হোক হৃদয়প্রান্তর

আমরা মুসলমানরা আল্লাহর পরে যার কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণী, তিনি আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তার উসিলায় আমরা আল্লাহর পরিচয় পেয়েছি। আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের পথপদ্ধতি পেয়েছি। জাহান্নাম থেকে বাঁচার ও জান্নাতে যাওয়ার পথঘাট চিনেছি। আমাদের প্রতি নবীজির অবদান এত বেশি যে, স্বয়ং আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ মোমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তার আয়াতগুলো তাদের কাছে তেলাওয়াত করেন, তাদের পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও আগে তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৬৪)।

প্রশ্ন হলো, মুসলিম উম্মাহর প্রতি প্রিয় নবীর এত দয়া অনুগ্রহের বিনিময়ে আমরা তাকে কী দিতে পারি, কীভাবে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি। আমাদের প্রাণ দিয়ে জীবন দিয়েও তো এই দয়া-দানের শোকরিয়া আদায় করা যাবে না। আল্লাহ পাকের বড় অনুগ্রহ যে, তিনি নবীজির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পথ আমাদের বাৎলে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আল্লাহ নবীর প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তার সব ফেরেশতারাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করে। হে ঈমানদাররা! তোমরাও নবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করো এবং তাকে যথযথভাবে সালাম জানাও। (সুরা আহযাব, আয়াত-৫৬)।

নবীজির জন্য আমাদের অনুগ্রহ প্রার্থনাকে বলা হয় দরুদ পাঠ ও সালাম নিবেদন। এ আমলের গুরুত্ব প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ পাক ভূমিকা রচনা করে বলেছেন, আল্লাহ নিজে নবীজির প্রতি অহরহ সালাত পাঠান, যার অর্থ অনুগ্রহ করেন এবং সব ফেরেশতারাও সালাত পাঠান। মানে নবীজির ওপর রহমত নাজিল করার জন্য সবসময় প্রার্থনা করেন।

প্রতিদিনের নামাজ শুদ্ধ ও কবুল হওয়ার জন্য শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতের মাধ্যমে নবীজির প্রতি সালাম এবং দরুদে ইবরাহিমের মাধ্যমে দরুদ পাঠাতে হয়, যা দরুদ ও সালামের অতুলনীয় গুরুত্বের প্রমাণ। মাহে রমজানে দরুদ ও সালামের এই আমলটি আমাদের জন্য নিয়ে আসতে পারে আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, বরকত, সৌভাগ্য।

আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে আল্লাহতায়ালা তার ওপর ১০ বার রহমত বর্ষণ করেন।’ (মুসলিম)।

নবীজির প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ তাঁর ভালোবাসার প্রমাণ। এ ভালোবাসা পরকালেও তার সান্নিধ্য লাভে ধন্য করবে। এরশাদ হয়েছে : কেয়ামতের দিন আমার অধিকতর কাছের লোক অর্থাৎ আমার সুপারিশ পাওয়ার অধিক হকদার হবে সেই ব্যক্তি, যে আমার প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে। (তিরমিজি) স্বয়ং নবীজি আমাদের বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠের জন্য উৎসাহিত করেছেন।

আউস ইবনে আউস বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম দিন হলো জুমাবার। কাজেই জুমার দিন তোমরা আমার প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠাবে। কেন না, তোমাদের দরুদ ও সালাম আমার কাছে পেশ করা হয়। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমাদের দরুদ ও সালাম (আপনার ওফাতের পর) আপনার কাছে কীভাবে পেশ করা হবে। অথচ তখন আপনি বালির সঙ্গে মিশে থাকবেন অথবা তারা বললেন, আপনি পচে যাবেন। নবীজি বললেন, আল্লাহতায়ালা মাটির জন্য নবীদের দেহ খেয়ে ফেলা হারাম করে দিয়েছেন। (আবু দাউদ)। এই হাদিস প্রমাণ করে, নবীজি (সা.) এবং সকল নবী-রাসুলগণ (আ) কবরজগতে জীবিত আছেন এবং তাদের মরদেহ অক্ষত। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর যেপ্রান্ত থেকেই নবীজির প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করা হয়, সেই দরুদ ও সালাম মদিনা মুনাওয়ারায় নবীজির খেদমতে পৌঁছে দেয়ার জন্য বিশেষ ফেরেশতারা নিয়োজিত আছেন।

মদিনায় শায়িত নবীজি কীভাবে গোনাহগার উম্মতের সালাত ও সালাম গ্রহণ করেন তার ধরনও বর্ণনা করা হয়েছে :

আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন আমার প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠায়, তখন আল্লাহ আমার রুহ ফিরিয়ে দেন। যাতে তার সালামের জবাব দেই। (আবু দাউদ)।

ইমাম নববী (রা.) বলেছেন : নবী করীম (সা.)-এর রুহ মোবরক সর্বক্ষণ আল্লাহর উলুহিয়্যতের ধ্যানে নিমগ্ন থাকে। উম্মতের কেউ যখন দরুদ ও সালামের নজরানা পাঠায় সেই অবস্থা থেকে তার ধ্যানকে ফিরিয়ে দেয়া হয়, যাতে তিনি উম্মতের সালামের জবাব দেন। নবীজি (সা.)-এর প্রতি সালাম নিবেদন ও সালামের জবাব লাভের এ সম্পর্ক মূলত ভালোবাসার বন্ধন। এ ভালোবাসার বন্ধনেই আমরা আল্লাহর সঙ্গেও যুক্ত। এ ভালোবাসাই আমাদের ঈমান ও জীবনের অবলম্বন।

আনাস ইবনে মালেক (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন : তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ আমি রাসুল তার কাছে তার সন্তান, পিতামাতা ও সব মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হব। (বোখারি ও মুসলিম)

প্রিয় নবীজির ভালোবাসা আমাদের আখেরাতেরও সম্বল।

আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণিত অপর এক হাদিসের ভাষ্য। এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জানতে চাইল, কেয়ামত কবে হবে। নবীজি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেয়ামতের জন্য তুমি কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ। বেদুইন বললেন, বেশি বেশি নামাজ রোজার সঞ্চয় আমার নেই; তবে আমি আল্লাহ ও রাসুলকে ভালোবাসি। তখন নবীজি বললেন, তুমি যাকে ভালোবাসা কেয়ামতের দিন তুমি তার সঙ্গে থাকবে। (বোখারি ও মুসলিম)। আল্লামা ইকবালের বিশ্ববিখ্যাত রচনা শেকওয়া মুসলমানদের দুর্দশার জন্য আল্লাহর কাছে অভিযোগ। জওয়াবে শেকওয়ায় তিনি আল্লাহর হয়ে সেই অভিযোগের জবাব দিয়ে বলেছেন, দুর্দশা থেকে মুক্তির পথ রাসুলে পাকের ভালোবাসা ও আদর্শের অনুসরণ। জওয়াবে শেকওয়ার শেষ দুটি লাইন এরূপ :

কী মুহাম্মদ ছে ওয়াফা তো নে তো হাম তেরে হেঁ

ইয়ে জাহঁাঁ ছিয হে কেয়া লৌহ ও কলম তেরে হেঁ

মুহাম্মদের সঙ্গে বিশ্বস্ততা রক্ষা করো তো আমি আল্লাহ তোমার

‘এই জগত তো অতি তুচ্ছ লৌহ ও কলমও হয়ে যাবে তোমার।’

প্রিয়কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় এই ভাবধারাটি আরও বাত্যয়।

‘নাই তাজ তাই লাজ

ওরে মুসলিম খর্জুর শীষে তোরা সাজ।’

ওহে মুসলিম জাতি! রাজত্বের মুকুট হারিয়ে হতাশায় লজ্জায় ভুগছ? তোমাদের মুক্তির পথ মদিনার খেজুরের শীষে, নবীজির আদর্শে সজ্জিত হওয়া।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত