ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সমাজ উন্নয়নে সিয়াম সাধনা

সমাজ উন্নয়নে সিয়াম সাধনা

‘রোজা একান্ত আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব।’ এই ঘোষণা হাদিসে কুদসি সূত্রে আল্লাহ তায়ালার। হাদিসে আরও বলা হয়েছে, ‘আদম সন্তানের যে কোনো নেক আমলের সওয়াব দেয়া হয় বহুগুণ। দশ থেকে সাতশ পর্যন্ত।’ নিয়তের বিশুদ্ধতার নিরিখে তারতম্য হয়। সব আমলের সওয়াব বা প্রতিদান দেয়া হয় ফেরেশতাদের মাধ্যমে। কিন্তু রোজার প্রতিদান দেন সরাসরি আল্লাহতায়ালা। এর কারণও বলা হয়েছে, ‘রোজাদার একমাত্র আমার জন্য (আল্লাহর ভয়ে ও মহব্বতে) পানাহার ও কামনা বাসনা বর্জন করে, কৃচ্ছ্রসাধনা করে।’ (বোখারি)।

কোরআন মজিদেও এর পক্ষে যুক্তি দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘যারা শাহওয়াত (কাম-লালসা) হতে ধৈর্য ধারণ করবে (বিরত থাকবে) তাদের পারিশ্রমিক কোনো হিসাবের আওতায় আসবে না; বরং তা সীমার বাইরে। (সুরা যুমার : ১০)।

দিনের বেলা পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থেকে আমরা রোজা রাখি। এটি রোজার মামুলি পরিচয়, আম জনতার রোজা। রোজার অতুলনীয় ফজিলত লাভ করতে হলে মামুলি সিয়াম সাধনা যথেষ্ট নয়। ইমাম গাযযালী (রহ.) রোজাকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। সর্বসাধারণের রোজা। খাস লোকদের রোজা। এবং খাসদের মধ্যে যারা খাস তাদের রোজা। শেষোক্ত শ্রেণির রোজাদারদের মনের গহিনে আল্লাহর ধ্যান ছাড়া কোনো বৈধ চিন্তাও আসতে পারবে না। এই স্তরটি সিদ্দিকীনদের, সাধারণ লোকদের চিন্তার বাইরে। দ্বিতীয় প্রকার খাস লোকদের রোজার ক্ষেত্রেও ধ্যান-মন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত রাখতে হবে।

হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে কথায় ও কাজে মিথ্যাকে বর্জন করেনি, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি)।

আবু হুরায়রা (রহ.) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রোজা রাখবে সে অশ্লীল বাক্যালাপ বা গালমন্দ করবে না। যদি কেউ গায়ে পড়ে তাকে গালি দেয়, ঝগড়া বাধায়, তবু সে (প্রতিউত্তর করতে পারবে না; বরং) বলবে যে, আমি রোজা রেখেছি। কাজেই তোমার কথার উত্তর দিতে অপারগ। (বোখারি, মুসলিম)।

ইমাম গাযযালী (রহ.) কিমিয়ায়ে সাআদাতে হাদিস সূত্রে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ‘দুইজন মহিলা রোজা রেখেছিল। তারা তৃষ্ণায় এমন কাতর হয়ে পড়ে যে, তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তারা রাসুল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে রোজা ভেঙে ফেলার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করল। তখন হজরত তাদের কাছে একটি পাত্র পাঠিয়ে দিলেন, যাতে ওই পাত্রে তারা বমি করে। এতে উভয়ের কণ্ঠনালি থেকে এক টুকরো করে কালো রক্তখণ্ড বেরিয়ে এলো। লোকেরা তাজ্জব বনে গেল। রাসুল (সা.) বললেন : এ দুই মহিলা আল্লাহতায়ালা যা হালাল করেছিলেন তা দিয়ে রোজা রেখেছে আর যা হারাম করেছেন তা দিয়ে রোজা ভেঙে ফেলেছে। তারা গিবতে লিপ্ত হয়েছে। তাদের কণ্ঠনালি থেকে যা বেরিয়ে এসেছে তা হচ্ছে মনুষ্য গোশত, যা তারা (গিবতের মাধ্যমে) ভক্ষণ করেছে।’

গিবত মানে গোশত খাওয়া। তাও মানুষের গোশত। আপন ভাইয়ের গোশত, মৃত ভাইয়ের লাশ কাটা গোশত। এটি কোরআন মজিদের কথা।

‘হে মোমিনরা তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ, অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা (গিবত) করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? বস্তুত তোমরা তা এ কাজকে ঘৃণাই করবে। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজুরাত : ১২)।

লোকালয়ে মসজিদ, রাস্তাঘাট, পুল, পুকুর, পয়োপ্রণালি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, বিনোদন কেন্দ্র থাকলে আমরা মনে করি সমাজের উন্নয়ন হয়েছে। ইসলাম সমাজের বাহ্যিক উন্নয়নকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। এমনকি মানুষের চলাচল পথের কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণকে ঈমানের অঙ্গ ও অন্যতম দাবি বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজের এই বাহ্যিক উন্নয়ন যথেষ্ট নয়; বরং আসল উন্নয়ন হতে হবে মানুষের চিন্তায়, চরিত্রে ও বাস্তব কর্মে। মানুষের মন থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, কুধারণা কুভাবনা দূর করতে হবে। গিবত, পরনিন্দা, পেছনে লেগে থাকার মতো গর্হিত কাজ থেকে মুক্ত ভালোবাসা ও আত্মীয়তার বাতাবরণ তৈরি হতে হবে। এটিই কোরআন মজিদের উপরোক্ত আয়াতের আবেদন।

এ জাতীয় নীতিকথা বলতে ও শুনতে আমাদের ভালো লাগে। তবে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন বড় কঠিন। কথাগুলো বিশ্বাসে ও আচরণে ফুটে উঠলে, আমাদের স্বভাব ও চরিত্রে মজ্জাগত হলেই শুধু এসব নীতিকথার সুফল পাওয়া সম্ভব। এ জন্য ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে, সুন্দর জীবন ও আদর্শ সমাজের জন্য মন্দ স্বভাবগুলো ব্যক্তি জীবন ও সামষ্টিক আচরণ থেকে বর্জন করতে হবে। আর চরিত্র ও স্বভাবে মানবীয় গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যগুলোর লালন ও পরিচর্যা করতে হবে। রমজানে একটানা এক মাসের কৃচ্ছ্রতা ও সিয়াম সাধনা এ ধরনের একটি উদ্যোগ, যেখানে প্রতিটি মানুষ সম্মিলিত প্রেরণায় আল্লাহর ইবাদত করবে, সঙ্গে মন্দকে বর্জন ও ভালোকে বরণের কাজটিও সুসম্পন্ন হবে। মূলত ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব ও সৌন্দর্য এখানেই।

নবী করিম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করে না, তাকে লাঞ্ছিত-লজ্জিত করে না, তার প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না। তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে বলে তিনি নিজের বুকের দিকে তিনবার ইশারা করেন। অতঃপর বলেন, মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে তার অন্য মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করবে। মনে রেখ এক মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের রক্ত, তার মাল ও তার সম্মান হারাম।’ (বোখারি)।

এসব মন্দ স্বভাব ব্যক্তির মনকে যেমন কলুষিত করে, সমাজকেও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। তাই নবী করিম (সা.) অত্যন্ত দরদমাখা ভাষায় আহ্বান জানিয়েছেন:

‘তোমরা অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না। কারও দোষ অনুসন্ধান করো না, কারও গোপনীয় বিষয় অন্বেষণ করো না, একে অন্যকে ধোঁকা দিও না, পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করো না। বরং তোমরা সবাই এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থাক।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত