হজ প্যাকেজের খরচ নিয়ে বিতর্ক চলছেই

প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রকীবুল হক

চলতি বছরের হজযাত্রীদের নিবন্ধন কার্যক্রম প্রায় শেষ হতে চললেও প্যাকেজ খরচ নিয়ে বিতর্ক থামছেই না। এরই মধ্যে সরকারঘোষিত উচ্চমূল্যের হজ প্যাকেজ কেন জনস্বার্থবিরোধী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। এছাড়া এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্বতন্ত্র টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া পুনর্নির্ধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন জানিয়েছে খোদ বেসরকারি হজব্যবস্থাপনায় জড়িত এজেন্সি মালিকদের সংগঠন-হাব। তবে এখন পর্যন্ত হজের খরচ কমানোর কোনো সম্ভাবনা নেই বলে ধর্ম মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এমনকি এবারের প্যাকেজকে হ্রাসকৃত প্যাকেজ এবং আগামীতে হজের খরচ আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মন্ত্রণালয়টি। সূত্র মতে, গতকাল রোববার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আবুল কাশেম মুহাম্মদ শাহীন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং সৌদি আরবের হারাম শরীফের নিকটবর্তী বিভিন্ন হোটেল ভেঙে ফেলায় এ বছর হোটেল ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং অধিক পরিমাণ অর্থ দিয়ে হোটেল ভাড়া করা হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় বিভিন্ন কারণে এ বছর হজ প্যাকেজকে হ্রাসকৃত প্যাকেজ হিসেবে ধরা যায়।

একই ধারাবাহিকতায় বলা যায়, আগামী বছরগুলোয় হজ প্যাকেজের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ, ভেঙে ফেলা বাড়ি/হোটেলসমূহ আবার গড়ে তুলতে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগবে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হজযাত্রীদের এ বছরই হজ প্যাকেজে নিবন্ধিত হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী সৌদি আরবে পবিত্র হজ পালনের অনুমতি পেয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন হজ পালন করার কথা। কিন্তু এবার খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে প্রাক-নিবন্ধন করেও শেষ পর্যন্ত হজে যাওয়ার জন্য নিবন্ধন করেননি অনেকে। যে কারণে কোটা বাকি থাকায় সপ্তম দফা সময় বাড়িয়ে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এখনো ৮ হাজার ৮৪৩ জন হজযাত্রীর নিবন্ধ বাকি রয়েছে। সূত্র মতে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজারের কোটায় নিবন্ধন করেছেন ৯ হাজার ৯৩৯ জন। আর বেসরকারিতে ১ লাখ ৮ হাজার ৪১৪ জনের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে।

হজ এজেন্সিগুলো বলেছে, সৌদি সরকার থেকে পাওয়া নির্ধারিত কোটা পূরণ করে হজযাত্রী পাঠাতে না পারলে আগামীতে এ সংখ্যক কোটা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। তাই কোটা পূরণ করতে বারবার সময় বৃদ্ধিসহ নানাভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে মন্ত্রণালয়।

বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের উপ-সচিব আবুল কাশেম মুহাম্মদ শাহীন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী দুই তিন বছরের মধ্যে বাসা ভাড়া কমার কোনো সুযোগ নেই। বরং বাড়তে পারে। বৈশ্বিক যে পরিস্থিতি আগামীতে বিমান ভাড়া কমবে সেটিও বলা যাবে না। এ পরিস্থিতিতে আগামীতে হজের খরচ কমবে না, বরং বাড়বে।

এটা নিবন্ধন বাড়ানোর জন্য একটা কৌশল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কৌশল নয়, সম্মানিত হজযাত্রীদের বিষয়টি অবহিত করতেই এ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বরাবর হাবের আবেদন প্রসঙ্গে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-হাবের সভাপতি এম শাহাদত হোসাইন তসলিম বলেন, হজের খরচ এবার বাড়ায় সাধারণ হজযাত্রীদের সঙ্গে আমরাও ব্যথিত। এজন্য আমরা বারবার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনো কাজ না হওয়ায় আমাদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছি। আমাদের বিশ্বাস তিনি উদ্যোগ নিয়ে নিশ্চয় হজের খরচ কমবে।

হাব সভাপতি আরো বলেন, মূলত, হজের খরচ দুইভাগে বিভক্ত, একটি সৌদি অংশের এবং বাকিটা এদেশের সঙ্গে জড়িত। সৌদি অংশের নির্ধারিত খরচ কমানোর কোনো সুযোগ আমাদের নেই। তবে এদেশের খরচের মধ্যে বিমান ভাড়া কমানোর সুযোগ আছে। আর এই বিমান ভাড়া কত কমানো সম্ভব বা হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণের জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের কথা বলেছি।

এদিকে সুষ্ঠুভাবে হজ ব্যবস্থাপনায় এবারের প্রস্তুতি ভালো বলে মন্তব্য করেছেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, এমপি। গতকাল তিনি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে হজ প্যাকেজ মূল্য বেড়েছে। রিয়ালের বিনিময় মূল্যে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া সৌদির ‘সি’ ক্যাটাগরির সেবা নেয়ার কারণেও খরচ বাড়ছে। এসব খরচ কমানোর কোনো সুযোগ নেই।

তবে হজযাত্রী যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে এখন কোনো অনিশ্চয়তা নেই জানিয়ে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেন, গতকাল পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৫১ জন নিবন্ধিত হয়েছেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫ হাজার এবং বেসরকারিতে ৩ হাজারের মতো বাকি আছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাকিগুলো নিবন্ধন সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এদিকে বিমান ভাড়া নির্ধারণে হাবের বিশেষ কমিটি গঠনের দাবি বিষয়ে তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান আরো বলেন, নির্ধারিত ফ্লাইট বিবেচনায় বিমান ভাড়া বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ আছে। তবে বিতর্ক এড়িয়ে বিমান ভাড়া নির্ধারণে কোন স্থায়ী কাঠামোর কথা ভেবে দেখা যায়। আগামী বছরের হজের আগে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

তিনি বলেন, হজের বিমান ভাড়া নিয়ে কথা হচ্ছে বেশি। তাই আগামীবার বিমান ভাড়া কিভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করা হবে।

উচ্চমূল্যের হজ প্যাকেজ কেন জনস্বার্থবিরোধী নয়- হাইকোর্ট : সরকারঘোষিত উচ্চমূল্যের হজ প্যাকেজ কেন জনস্বার্থবিরোধী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

গতকাল রোববার বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট গাজী মো. মহসীন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।

গত ১২ মার্চ হজের প্যাকেজ মূল্য কমিয়ে পুনরায় প্যাকেজ ঘোষণা করতে রিট দায়ের করা হয়। রিটে বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্স ছাড়া যেকোনো এয়ারলাইন্সে টিকিট কেটে হজে যাওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আশরাফ উজ জামান জনস্বার্থে এ রিট দায়ের করেন।

ধর্ম সচিব, বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়েছে।

এর আগে গত ৬ মার্চ হজের প্যাকেজ মূল্য সংশোধন করে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করতে সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও আল কোরআন স্টাডি সেন্টারের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট আশরাফ উজ জামান ধর্ম মন্ত্রণালয়কে এ নোটিশ পাঠান।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সৌদি আরব, ইরান, তুরস্কের সরকারকে নোটিশের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে হজের প্যাকেজ পুনর্র্নিধারণ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও নোটিশে জানানো হয়। সাত দিন পার হলেও হজের প্যাকেজ কমানোর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এ রিট দায়ের করা হয়েছে বলে জানান আইনজীবী আশরাফ উজ জামান।

৬ মার্চ আইনজীবী আশরাফ উজ জামান বলেছিলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ-সৌদি-বাংলাদেশ রুটে প্লেন ভাড়া ৭৬ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। প্রতি বছর দুই দেশের সরকার হজযাত্রীদের সৌদি ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকিট কিনতে বাধ্য করে। এ কারণে টিকিট কিনতে হজ যাত্রীদের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়।

এসব কারণসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে চার লাখ টাকার মধ্যে হজ প্যাকেজ-২০২৩ সংশোধন, পরিবর্তন এবং পুনর্নির্ধারণ করতে নোটিশে অনুরোধ করা হয়।

সূত্র মতে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলতি মৌসুমে হজের খরচ ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। অন্যদিকে, কোরবানি ছাড়াই এবার বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের জন্য সর্বনিম্ন খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। আগের বছর এটি ছিল ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৪৪ টাকা। অর্থাৎ, আগের বছরের চেয়ে দেড় লাখ টাকা বেড়েছে। অবশ্য সৌদির সেবা মূল্য কমানোর পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষিত প্যাকেজমূল্য থেকে ১১ হাজার টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়।