চট্টগ্রামে বিপুল অবৈধ ইটভাটা

উচ্চ আদালতের বন্ধের নির্দেশনাও উপেক্ষিত

প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামজুড়ে গড়ে উঠেছে পরিবেশ দূষণকারী বিপুল অবৈধ ইটভাটা। এসব ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়া বা উচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে নেই কোনো কার্যকর প্রশাসনিক তৎপরতা। এর ফলে যখন-তখন যত্রতত্র গড়ে উঠছে ইটভাটা। অবৈধ ইটভাটার দূষণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। দূষণ ঠেকাতে এসব ইটভাটা বন্ধে প্রশাসনিক তৎপরতা মন্থর। এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও।

চন্দনাইশ উপজেলার কাননগর এলাকা একসময় পেয়ারা এবং ধানের জন্য খ্যাত ছিল। অথচ এখন ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় বিবর্ণ সেই এলাকা। পেয়ারা বাগানসহ আশপাশের বিশাল জায়গায় গড়ে উঠেছে ৩০টির বেশি ইটভাটা। এর মধ্যে ২৫টিরই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। এসব ভাটায় ইট তৈরির সঙ্গে পুড়ছে বনের মূল্যবান কাঠ। নিয়ন্ত্রণহীন দূষণে বিবর্ণ হচ্ছে পরিবেশে বিপন্ন হচ্ছে মানুষের নিত্যজীবন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের ১৩ নভেম্বর দেশের সব জেলার অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনা পেয়ে সাতকানিয়া উপজেলার একটি ইটভাটা বন্ধ করেছিল প্রশাসন। এরপর আর কোনো ইটভাটা বন্ধ করা হয়নি। তবে বৈধ ও অবৈধ ইটভাটার তালিকা করে তা জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। কিন্তু এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অজুহাত পর্যাপ্ত জনবল এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। বন্ধের পরিবর্তে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে দায় সারছে- এমন অভিযোগ রয়েছে বিস্তর।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলায় ইটভাটা আছে ৪১৩টি। এর মধ্যে অনুমোদনহীন ইটভাটার সংখ্যা তিন শতাধিক। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন আছে ১২০টির। অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে কাঠ ও কয়লা পোড়ার পাশাপাশি বাতাসে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, গেল মার্চে বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। মার্চে ১০ দিনের মধ্যে তিন দফা অভিযানে সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও চন্দনাইশ উপজেলায় পাঁচ ইটভাটাকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে ২০ মার্চ বাঁশখালী উপজেলার এমবিএম এবং এনটিবি নামে দুই ইটভাটাকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কয়লার পরিবর্তে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো এবং কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে ইট তৈরির অভিযোগে এসব জরিমানা করা হয়। এর আগে সাতকানিয়া উপজেলায় তিনটি ইটভাটাকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তার আগে চন্দনাইশে দুটি ইটভাটাকে ১ লাখ টাকা করে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, জেলার ১৫ উপজেলায় ইটভাটা আছে ৪১৩টি। এর মধ্যে ফিক্স চিমনি (৮৯-১২০ ফুট উঁচু) ইটভাটা আছে ২৭৩টি, জিগজ্যাগ চিমনি আছে ১১৬টি এবং পরিবেশ ফ্রেন্ডলি টেকনোলজির ইটভাটা আছে ১১টি। ইটভাটা পরিচালনার জন্য ছাড়পত্র আছে ১২০টির। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে আরো ২৯৩টি ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে অনুমোদন ছাড়া অবৈধভাবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী উপজেলায় ১২টি ইটভাটার মধ্যে সবগুলোর অনুমোদন আছে। এর মধ্যে আনোয়ারায় দুটির মধ্যে একটি, পটিয়ায় দুটির মধ্যে একটি, সন্দ্বীপে ১১টির মধ্যে ৯টি, বাঁশখালীতে ১২টির মধ্যে ১০টি, বোয়ালখালীতে পাঁচটির মধ্যে চারটি, মীরসরাইয়ে ১৫টির মধ্যে ৯টি অবৈধ। সীতাকুন্ডের আটটির মধ্যে ছয়টি, চন্দনাইশে ৩২টির মধ্যে ২৫টি, লোহাগাড়ায় ৪৮টির মধ্যে ৪৫টি, ফটিকছড়িতে ৫৫টির মধ্যে ৪৩টি, সাতকানিয়ায় ৭০টির মধ্যে ৪৫টি, রাউজানে ৩৭টির মধ্যে ২৯টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৬৯টির মধ্যে ৬৬টি ও হাটহাজারীতে ৩৫টির মধ্যে ২০টি অবৈধ।

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা আছে, লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা চালালে ২ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একইভাবে ইটভাটায় মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিশেষ করে টপ সয়েলের ব্যবস্থা বন্ধ করা, ইটের বিকল্প ব্লক উৎপাদন ও ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা আরোপ, ভাটার জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক এবং ব্লক তৈরিতে লাইসেন্সের অপ্রয়োজনীয়তা, নির্দিষ্ট এলাকায় ইটভাটার জায়গা ও ভাটার সংখ্যা নির্ধারণ করা।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। আমরা মনে করেছিলাম, পরিবেশ অধিদপ্তর সব অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করবে। অথচ প্রশাসন উচ্ছেদ না করে জরিমানা করে দায় সারছে। জরিমানা করা মানে অবৈধ ইটভাটার মালিকদের সহযোগিতা করা, অবৈধতাকে বৈধতা দেয়া। ইটভাটার নামে ভূমিদস্যুরা চন্দনাইশে পাহাড় ধ্বংস করছে। এলাকার অনেক চাষাবাদের জমি ইটভাটার আওতায় এনে ধ্বংস করা হয়েছে।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় রয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইটভাটা। এসব ইট ভাটার কারণে এক সময় পেয়ারা চাষের জন্য পরিচিতি পাওয়া ওই উপজেলার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মানবাধিকার তথ্যানুসন্ধ্যান টিমের উদ্যোগে শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে গেল ১২ মার্চ সকালে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহায়তায় স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালায়। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিমরান মুহাম্মদের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে স্থানীয় চেয়ারম্যান রোকনের মালিকানাধীন এসএবিসহ দুটি ইটভাটাকে ১ লাখ টাকা করে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তবে নিয়ম অনুযায়ী অবৈধ ইটভাটা গুড়িয়ে দেয়া কিংবা উচ্ছেদ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। জরিমানার পরও দিব্যি ইট তৈরির কাজ চলছে ওই দুই ইটভাটায়।