ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অসহায় মানুষের সেবায় আল্লাহর রহমত পাওয়া যায়

অসহায় মানুষের সেবায় আল্লাহর রহমত পাওয়া যায়

বিশ্ববরেণ্য সাধক কবি মওলানা জালাল উদ্দীন রুমি (রহ.)। তার রচিত বিশ্ববরেণ্য মসনবি শরিফের কয়েক লাইন কবিতায় ইসলামের একটি শাশ্বত জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে। কবিতায় তিনি একটি দৃশ্যপট এঁকেছেন চমৎকারভাবে।

মরুভূমির ধু ধু বালুচর। অনেক দূরে দেখা যায় সবুজ গাছগাছালি মাথা নাড়ছে। কীভাবে সম্ভব মরুবিয়াবানে সবুজের অস্তিত্ব। কাছে গিয়ে দেখে, নিচে পানির ঝিরিঝিরি ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে। সেই পানির পরশে তপ্ত মরুতে জেগেছে প্রাণের শিহরণ, সবুজের বনায়ন।

এখানেই তিনি তার দর্শন ব্যাখ্যা করে বলেন, যেখানে অশ্রু ঝরে, মানুষ আল্লাহর ভয়ে ও ভালোবাসায় কাঁদে সেখানে অবারিত আল্লাহর রহমত নামে। হার কুজা আবে রওয়াঁ সবজা শওয়াদ

হার কুজা আশকি দওয়াঁ রহমত শওয়াদ

যেখানে পানির প্রবাহ সবুজের সমারোহ জাগে

যেখানে অশ্রু প্রবহমান আল্লাহর রহমত নামে।

তার জোরালো উপদেশ, আল্লাহর রহমত পেতে হলে তোমার দুই চোখ হতে হবে দোলাবের মতো। কূপ থেকে পানি তোলার হাতিয়ার বালতি। গভীর কূপ থেকে পানি তোলার সময় বালতি থেকে পানি ঝরে, আবার যখন পানি তোলার জন্য বালতি কুয়ায় নামানো হয়, তখনও পানি ঝরতে থাকে। কুয়া থেকে পানি তোলার বালতির নাম দোলাব। মওলানার চিন্তায় দোলাব থাকে সারাক্ষণ অশ্রুসজল। তিনি বলেন, দোলাবের মতো অশ্রুসজল হতে পারলে তোমার প্রাণের জমিনে সবুজের বনায়ন হবে।

বাশ চোন দোলাব নালান চশম তর

তা যে চাহনে জাঁত বর রূয়াদ খোযর

দোলাবের মতো হও তুমি সদা অশ্রুঝরা

প্রাণের জমিতে জাগুক তোমার সবুজের চারা।

মওলানার কাছে জিজ্ঞাসা, অশ্রু ও কান্না তো এ যুগে দুর্লভ আপনার শিষ্য আল্লামা ইকবাল তো বলেছেন, আমার অভিজ্ঞতায় পৃথিবীর বুকে দুর্লভ বস্তু হলো সুখী মানুষের চোখের অশ্রু।

সালহা আন্দর জাহান গর্দীদা আম

নম বে চশমে মুনয়েমান কম দিদাআম

বহুকাল আমি ঘুরেছি খুঁজেছি জগৎ মাঝ

সুখী মানুষের চোখে দেখিনি অশ্রু কদাচ। (জাভিদনামা)

কাজেই মওলানা আপনি বলুন কীভাবে আমরা কাঁদতে পারব, আমাদের প্রাণের জমিতে কীভাবে সবুজের সমারোহ আসবে। মওলানা জবাব দেন। তোমার চোখে অশ্রু পেতে চাও? তার সহজ পথ আছে। যাদের কাছে সবচেয়ে সস্তা চোখের পানি, দুঃখী মানুষ, যারা সারাক্ষণ অশ্রুসজল তাদের প্রতি দয়া দেখাও। তাহলে তোমার চোখেও আল্লাহর ভয়ের অশ্রুমালা নামবে। কাঁদার শক্তি তোমার মধ্যেও সঞ্চারিত হবে। আর যদি আল্লাহর রহমত পেতে চাও তার জন্যও সহজ একটি পথ আছে।

আশক খাহী রহম কুন বর আশকবার

রাহম খাহী বর যয়ীফান রাহম আর

অশ্রু যদি চাও দয়া কর অশ্রুসজলদের প্রতি

রহমত পেতে চাও দয়া দেখাও দুর্র্বলদের প্রতি।

মওলানা রুমি মূলত হাদিস শরিফের বাণীকে দর্শনের আয়নায়, কবিতার ব্যঞ্জনায় ব্যক্ত করেছেন। প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেন,

‘জমিনে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া দেখাও, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি রহমত করবেন।’ (তিরমিজি, রিয়াদুস সালেহিন)।

অসহায়, দুর্বল, দুঃখী মানুষের প্রতি সহমর্মিতার এই আহ্বান নিয়ে এসেছে মাহে রমজান। জনসভায় বক্তৃতার মঞ্চে, ভোটের আগে আগে গরিবের প্রতি যাদের দরদ উপচে পড়ে তারা কী সত্যিই গরিব-দুঃখী মানুষের দুঃখ বুঝেন। সমাজে যাদের আছে তারা বুঝে না, যাদের নাই তাদের দুঃখ-বেদনা। তাই অভাবের সংসারে না খেয়ে থাকা বা বাচ্চাদের মুখে খাবার দিতে না পারার বেদনা বাস্তবে উপলব্ধি করার ব্যবস্থা রমজান সাধনা। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘ওয়া শাহরুল মুওয়াসাত।’ ‘রমজান পারস্পরিক সহানুভূতির মাস।’

ইসলাম ধনীর সম্পদে গরিবের হক নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছে, যাদের কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার পরিমাণ অতিরিক্ত সম্পদ এক বছর পর্যন্ত মজুত থাকবে, তাদের ওপর ফরজ হলো চল্লিশ ভাগের এক ভাগ প্রধানত গরিবদের মালিকানায় দিয়ে দিতে হবে। পৌনে দুই কেজি আটার পরিমাণ মাথাপিছু ফিতরা আদায় করতে হবে ঈদের আগে আগে পরিবারের ছোট-বড় সদস্যদের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেয়া, সবাই মিলে ইফতার ও দান-সদকায় পারস্পরিক সহমর্মিতার বেহেশতি পরিবেশ ও অনুশীলন হয় রমজানে।

হাতের সব আঙুল এক সমান হলে মানুষ কোনো কাজ করতে পারত না, জীবনযাত্রা অচল হয়ে যেত। সমাজের সব মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থাও এক সমান হলে সমাজ অচল হয়ে যেত। এ জন্য আল্লাহপাক ধনী-গরিবের ব্যবধান সৃষ্টি করে সমাজ সংসারকে সুন্দররূপে বিন্যস্ত করেছেন। গরিবদের বলেছেন, ধৈর্য ধর, ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাও, আল্লাহর সাহায্যের ওপর ভরসা রাখ। সম্পদশালীদের বলেছেন, তোমাদের সম্পদ একা তোমাদের অর্জিত নয়, আল্লাহর দান। এই দান অসহায় গরিবদের উসিলায়। হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে-

আবুদ দারদা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : তোমরা আমার সন্তুষ্টি অন্বেষণ কর নিঃস্ব দুর্বলদের মধ্যে। কেননা, তোমরা তাদের উসিলায় সাহায্য ও রিজিক পেয়ে থাক। (আবু দাউদ এর বরাতে রিয়াদুস সালেহিন ঃ হাদিস নং ২৭২)।

নবী করিম (সা) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, বিধবা, বৃদ্ধ ও মিসকিনদের সাহায্যের জন্য চেষ্টা সাধনাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মতো। (বর্ণনাকারী বলেন) আমার ধারণা নবীজি এ কথাও বলেছেন, সে অবিরাম নামাজ আদায়কারী ও অনবরত রোজা রাখা ব্যক্তির মতো। (বোখারি ও মুসলিম)।

অনেকের ঘরে প্রতিবন্ধী আছে। অনেকে প্রতিবন্ধীদের লালন-পালন করেন, কিংবা বিধবা অসহায় নারীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করেন। কাজটি কত মহৎ তার পরিচয় পাওয়া যায় উপরোক্ত হাদিসে। নবীজি (সা.) বলেছেন, তোমাদেরকে যে আল্লাহ রিজিক দেন, সম্পদের অধিকারী করেছেন, তাতে অবলা, অসহায়, প্রতিবন্ধীদের জন্য আল্লাহর দেয়া হিসসাও শামিল আছে। হাদিসের ভাষায় ‘তাদের উসিলাতেই তোমাদের রিজিক দেয়া হয়, সাহায্য পৌঁছানো হয়।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত