বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন নিঃস্ব হাজারো ব্যবসায়ী

* পাঁচ হাজারের অধিক দোকান পুড়ে ছাই * সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে * ৩ হেলিকাপ্টারে পানি নিক্ষেপ * উদ্ধারে ৪৮ ইউনিট * সেনা-নৌ-বিমান-র‍্যাব-বিজিবি-আনসারের অংশগ্রহণ

প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

সারা বছরের মধ্যে ঈদ সামনে রেখে রমজান মাসেই কাপড় ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা হয় বেশি। তাই ঈদকে সামনে রেখেই কোটি কোটি টাকার কাপড় মজুত করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু গতকাল সকালে ঘুম ভাঙে তাদের রুটি-রুজির স্বপ্নে ভয়াবহ আগুনের লেলিহানে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় সব কিছু। গতকাল সকাল ৬টা ১০ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবাজারে লাগা আগুন প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই আগুনে প্রায় ৫ হাজারের অধিক দোকান পুড়ে ছাই হওয়ার পাশাপাশি ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতির দাবি করেছে দোকান মালিক সমিতির নেতারা। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার ব্যবসায়ী। এদিকে দীর্ঘ সময়ের আগুন আশপাশের বিপণিবিতানগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে একযোগে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের পাশাপাশি কাজ করেছে সেনা-নৌ-বিমান বাহিনী, পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবি-আনসার ও সাধারণ মানুষ। বিমান বাহিনীর তিনটি হেলিকপ্টারে করেও ছিটানো হয় পানি। হাতিরঝিল থেকে তিনটি হেলিকপ্টারে করে পানি নিয়ে বঙ্গবাজার মার্কেটে ছিটানো হয়েছে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দীর্ঘ হোস পাইপ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুর থেকে পানি ছিটিয়েছে।

এত কিছুর পরও ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই বঙ্গবাজার। আশপাশের মার্কেটগুলোও পুড়েছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবাজার আদর্শ মার্কেট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা পুরো মার্কেটসহ বরিশাল প্লাজায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে এনেক্সকো টাওয়ার, মহানগর, বরিশাল প্লাজা দাউ দাউ করে জ্বলেছে। বাতাসের কারণে আগুনের ব্যাপকতা বাড়তে দেখা গেছে। মহানগর মার্কেটের পাশঘেঁষে আগুন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের দিকেও এগিয়েছিল। ভেতর থেকে পানি ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ফায়ার সার্ভিস। আগুনের তীব্রতা এত ভয়াবহ ছিল যে, আকাশের মেঘ এবং আগুনের ধোঁয়া মিশে একাকার হয়ে ভযঙ্কর দৃশ্য দেখা যায়।

এদিকে আগুনে বঙ্গবাজারে টিনশেড মার্কেট পুরোটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এতে মার্কেটের প্রায় ৫ হাজার দোকান পুড়ে ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ব্যবসায়ীরা দোকানের মালামাল সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও আগুনের ধোঁয়ায় মালামাল সরাতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে। গতকাল সকাল সোয়া ৬টার দিকে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। তবে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি।

আগুন সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি জানিয়েছেন ওই ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। অন্তত ১০ বার নোটিশ দেয়া হয়েছে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনটি প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছে ফায়ার সার্ভিস। এসব কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি। গতকাল দুপুরে গণমাধ্যমকর্মীদের ব্রিফ করতে গিয়ে মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আর আগুন ছড়াবে না। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট কাজ করেছে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রধান বাধা ছিল উৎসুক জনতা। পানির স্বল্পতা ও বাতাসের কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে। উৎসুক জনতার কারণে কাজ করতে সমস্যা হয়েছে। আগুন নেভাতে পানির স্বল্পতার কথা বলেন মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পানির বাউজার এনে এবং ওয়াসাও পানির বিষয়ে সহায়তা করেছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে অনেক বাতাস ছিল। বাতাসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আগুন চলে যায়। এর ফলে নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে। ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয় ৪ বছর আগে।

এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, আগুনের উৎস সম্পর্কে তদন্তের আগে কিছু জানানো যাবে না। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল এই ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টানিয়েছিলাম। ১০ বার নোটিশ দিয়েছি, করণীয় যা যা করেছি। তারপরও ব্যবসা চলছিল।

এ বিষয়ে অন্য সংস্থার গাফিলতি থাকলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি। আগুন নির্বাপণের পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি। তদন্তের পর অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটা, তা জানাতে পারবেন বলে জানান মহাপরিচালক। ফায়ার সার্ভিস ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করবে বলেও জানান তিনি।

মহাপরিচালক জানান, এক ব্যক্তির মুঠোফোন নম্বর ও জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে প্রথমে আগুনের খবর পেয়েছিলাম। আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট, বিজিবি, পুলিশ, ওয়াসা, গণমাধ্যমকর্মীসহ অনেকে সহায়তা করেছেন বলে জানান তিনি।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের আটজন আহত হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ জনগণ আহত হওয়ার তথ্য জানা নেই। দুজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুমে হামলা প্রসঙ্গে মো. মাইন উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বঙ্গবাজার আর ফায়ার সার্ভিসের হেডকোয়ার্টার রাস্তার এপাশ আর ওপাশ। সাড়ে ৬টায় আমি ঘটনাস্থলে এসেছি। ডিজি হিসেবে জনগণের জানমালের উদ্ধারে জীবন দিচ্ছি। কেন বা কারা ফায়ার সার্ভিসের অফিসে আঘাত করল, তা আমার বোধগম্য নয়। আমি মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে বলতে চাই, ফায়ার সার্ভিস যেকোনো দুর্যোগে সবার আগে পাশে দাঁড়ায়। কেন এই আক্রমণ, আঘাত- এই প্রশ্ন আপনাদের কাছে রাখছি।

এদিকে বিকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, আগুনে প্রায় ৫ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের সহায়তায় সরকার সর্বোচ্চটুকু করবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এই অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ। এখন যারা আহত হয়েছেন, তাদের ১৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাড়ে ১৪ কেজি করে খাবার দেয়ার কথা জানান ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। তিনি জানান, এর মধ্যে থাকবে চাল, ডাল, তেল ও মসলা। এই আগুনের ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের পুনর্বাসনে যথাযথ সহায়তা দেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন এনামুর রহমান। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে তাদের পুনর্বাসনে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি) ৪ বছর আগে বঙ্গবাজার ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেন, বঙ্গবাজার মার্কেট ২০১৯ সালে করপোরেশন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। তখন নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সে সময় মার্কেট সমিতি নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে এবং হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। এতে সিটি করপোরেশনের কিছু করার ছিল না। গতকাল বিকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কার্যালয় নগর ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।

নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার ব্যবসায়ী

বঙ্গবাজার মার্কেটে তিন ভাই জামাল মিয়া, চান মিয়া ও কামাল মিয়ার দোকান ছিল। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তিন ভাইয়ের দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দোকান থেকে কিছুই বের করতে পারেননি তারা। সব হারিয়ে এখন শুধুই কাঁদছেন তিন ভাই। বছর দুয়েক আগে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ৪০ লাখ টাকা দিয়ে বঙ্গবাজারে একটি দোকান ভাড়া নেন ইভা ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী ইব্রাহিম। ঈদের আগে নতুন মালামালসহ তার দোকানে ২০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের মালামাল ছিল। কিন্তু, আগুনে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। ইব্রাহিম আহাজারি করতে করতে বলেন- ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে।’

আরেক দোকান মালিক বলেন, আমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। কীভাবে পরিবারের ভরণপোষণ করব জানি না। সিরাজুল ইসলাম নামের আরেক ব্যবসায়ী আগুন লাগার খবর পেয়ে বঙ্গবাজারে ছুটে যান। সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমার দোকানে ২০ লাখ টাকার পোশাক ছিল। আমি প্রায় অর্ধেক পণ্য বের করতে পেরেছি, কিন্তু সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। পানির কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আরেক ব্যবসায়ী রাকিব বলেন, তিনি তার দোকান থেকে এক টুকরো কাপড়ও বের করতে পারেননি। আগুনের ভয়াবহতার কারণে ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল উদ্ধার করতে পারেননি। আশপাশের অনেক দোকান থেকেও অনেক মানুষকে তাদের জিনিসপত্র বের করতে দেখা গেছে। তারা তাদের মালামাল রাস্তায় রেখেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একজন দিদার হোসেন বলেন, আমার দোকানে ১০ লাখ টাকার নতুন জামাকাপড় ছিল। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আওলাদ হোসেন নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের কিছুই অবশিষ্ট নেই। আগুন আমাদের সব আশা কেড়ে নিয়েছে।

বঙ্গবাজারে দুটি ও এনেক্সকো টাওয়ারে একটি শাড়ির দোকান ছিল সাইদুর রহমানের। সব আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে ছাই। তিনি বলেন, আগুনের খবর পেয়ে সকাল ৭টার দিকে এসেছি। এসে দেখি পাশের মার্কেটে আগুন। আসার পর বঙ্গ মার্কেটে আগুন লাগতে দেখেছি। তখন সামান্য মাল সরাতে পেরেছি। এরপর এনেক্সকো মার্কেটেও আগুন লেগে যায়।

নারী ও শিশুদের জামাকাপড়ের দুটি দোকান সাইফুল ইসলামের। তিনি বলেন, ৮টায় এসে দেখি বঙ্গমার্কেট পুড়ে শেষ। আমাদের গোডাউনে সব মাল থাকে। বঙ্গতে গোডাউন। ওগুলো কেউ বের করতে পারেনি। সব পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু পানি নাই। আগুন সব দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভ্যানে করে বস্তাভর্তি জামাকাপড় সরাতে দেখা গেছে গাড়িচালক শাহ আলমকে। তিনি বলেন, মহানগর মার্কেট থেকে কিছুটা মাল সরানো গেছে। এখন এটাও পুড়ছে। আগুনে সব শেষ।

রোজার ঈদকে টার্গেট করে ক’দিন আগেই ৭৫ লাখ টাকার মালামাল গোডাউনে মজুত করেছিলেন এক ব্যবসায়ী। বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুনে তার সাতটি দোকান ও গোডাউনের প্রায় ২ কোটি টাকার কাপড় পুড়ে গেছে। সব হারিয়ে বঙ্গবাজারের মার্কেটের সামনেই আহাজারি করছিলেন ওই ব্যবসায়ী। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন ‘ও ভাই, কিছু নাই, সব পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কয়েক দিন আগে গোডাউনে ৭৫ লাখ টাকার মাল ওঠানো হয়েছে। আমার ২ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। গোডাউন, দোকান সব শেষ।’ ওই ব্যবসায়ী জানান, ‘বঙ্গবাজারে তাদের গোডাউন ও সাতটি দোকান রয়েছে। নাম হাসান গার্মেন্টস। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের নাম সাফায়েত। আমার ভাইরে তো খুঁজে পাচ্ছি না।’

বঙ্গবাজার রাস্তার পাশেই সাগর ও মো. আলী নামে দুই ভাইয়ের কাপড়ের দোকান। ঈদ উপলক্ষ্যে প্রায় ৫ লাখ টাকার পণ্য দোকানে তুলেছিলেন তারা। যার অধিকাংশই কেনা ঋণ করে। গত রোববারও এনেছেন প্রায় লাখ খানেক টাকার কাপড়। দুপুরে পরিশোধ করার কথা ছিল ৬০ হাজার টাকা। ক্যাশ বাক্সের ভেতর কাপড়ে পেঁচিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সাগর বলেন, ‘আমার সবকিছু চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল। এত চেষ্টা করলাম কাছেও যাইতে পারলাম না। এখন আগুন নেভার পর টাকার ব্যাগটা খুঁজতেছি। তাও পাই না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দুই ভাই ৫ লাখ টাকার কাপড় তুলছি। ৩ লাখ, সাড়ে ৩ লাখ টাকার মতো ধারে। আর মানুষের কাছে টাকা পাই ১ লাখ টাকার মতো। সেই খাতাটাও পাচ্ছি না। ঈদের মৌসুমে পথে বসে গেলাম। কিছুই থাকল না। দীর্ঘ ৭ বছর কাতারে ছিলেন মো. আলী। তিনি বলেন, আমার বাইরে থেকে আনা সব কিছু নিয়েই এই দোকান। কিছুই থাকল না। পথে বসে গেলাম।’

হঠাৎ হঠাৎ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছেন হতভম্ব জাকির মোল্লা। তাকিয়ে আছেন আগুনের দিকে। ভয়ঙ্কর আগুনে দোকান পুড়েছে তার। স্বপ্ন হয়েছে ছাই। দেড় মাস হয়েছে মহানগর কমপ্লেক্সের নিচ তলায় দোকান দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়েছেন ১৫ লাখ টাকা। সবটুকুই বিনিয়োগ করেছেন দোকানে। জাকির বলেন, ‘আগুনের খবর পেয়ে সাড়ে ৬টায় আসছি। এসে দেখি সব জ্বলছে। জীবনের মায়ার ভয়ে আর দোকানে ঢোকার সাহস পাই নাই। শেষে একটু ঢুকতে পারছিলাম। কিন্তু মালামাল বের করতে পারি নাই।’

১৪ বছর সৌদি আরবে ছিলেন জাকির। সেখান থেকে এসে দেশেই ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন। তাই মহানগর কমপ্লেক্সে নিচতলায় দোকান দিয়েছিলেন। তার দোকানের নাম জেরিন জারিফা। মেয়েদের কাপড় বিক্রি করতেন। তিনি বলেন, ‘এখন আমি পুরা নিঃস্ব। ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। পুরোটাই বিনিয়োগ করছি। পাঁচ ভাই থেকে নিছি ৫ লাখ টাকা। অনেক আশাভরসা নিয়া ব্যবসা করতে নামছিলাম। সব শেষ আমার।’

ফায়ার সার্ভিস ভবনে বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের হামলা

রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা ফায়ার সার্ভিসের ভবনে হামলা চালিয়েছে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বঙ্গবাজারের উল্টোদিকে ফায়ার সার্ভিসের ভবনে এই হামলার ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকও এ অভিযোগ করেছেন। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার রহিমা খানম জানিয়েছেন, কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষ এসে হামলা করেছে। তারা ফায়ার সার্ভিসের ভবন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়েছে এবং ভেতরে থাকা গাড়ি ভাঙচুর করেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। ফায়ার সার্ভিস ভবনের ফটকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত ১৭

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, দোকান মালিক ও কর্মচারীসহ ১৭ জন আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্নে ও ঢাকা মেডিক্যালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। আহত অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার শেখ হাসিনা বার্নে ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। পাঁচজনকে ভর্তি করা হয়েছে।

পাঁচটি ওয়াটার ক্যানন ও ২ হাজার পুলিশ কাজ করেছে

বঙ্গবাজারে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের সাথে পাঁচটি ওয়াটার ক্যানন ও ২ হাজার পুলিশ সদস্য কাজ করেছে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে রাজারবাগ থেকে ৫টি ওয়াটার ক্যানন এনে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমাদের ওয়াটার রিজার্ভার থেকে প্রায় ২ লাখ লিটার পানি সাপ্লাই দিয়েছি। আমাদের ২ হাজার ফোর্স এই এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর বিকাল সোয়া ৩টার দিকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইজিপি। এ সময় তিনি এ তথ্য জানান।

পুলিশ সদর দপ্তরে আগুনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের একটি ব্যারাকে আগুন লেগেছে। সেখানে থাকা আমাদের সব সদস্য নিরাপদে বের হতে পেরেছেন। তবে মালামাল বের করতে পারিনি। এখন ডকুমেন্টস ও মালামাল কী কী ক্ষতি হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে হামলা প্রসঙ্গে আইজিপি বলেন, আপনারা দেখেছেন কী অবস্থা, এখানে হাজার হাজার মানুষ। হামলার খবর পেয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই গিয়েছি, এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। পরে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘটনাটা যখন ঘটেছে, আগে থেকে প্রস্তুতি ছিল না। ধীরে ধীরে আমরা শক্তি বৃদ্ধি করেছি, পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি। এখন পুরো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ট্রাফিক ব্যস্থাপনাও ঠিক রেখেছি। যার কারণে এত বড় ঘটনার পরও ঢাকার ট্রাফিক সচল ছিল।

চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আরো বলেন, এরই মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নাশকতার কোনো ঘটনা ধাকলে কমিটির তদন্তে বের হয়ে আসবে। আমরা সেই রিপোর্টের অপেক্ষায় থাকব। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যই নেব।

উদ্ধারকাজে এলো শিশু-কিশোররাও

বঙ্গবাজারে লাগা আগুন ফায়ার সার্ভিস থেকে শুরু করে অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকাজে ব্যস্ত ছিলেন। এর মধ্যে দেখা গেল ভিন্ন এক দৃশ্য। আগুন নেভাতে ছুটে এসেছে শিশু-কিশোররাও। আগুন নেভানোর কাজে তারাও ফায়ার সার্ভিসের ব্যবহৃত পানি পুনরায় সংগ্রহ করে আবার ব্যবহারে সহযোগিতা করছে।। তারা সেখান থেকে বালতি ও জারের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করে উদ্ধার কর্মীদের দিচ্ছে। কেউ আবার পানির জার ও বালতি নিয়ে দৌড়াচ্ছে।

১০ থেকে ১২ বছর বয়সি শিশু বিজয় জানায়, আগুন লাগার খবর শুনে নেভাতে এসেছি। থাকি কমলাপুর স্টেডিয়ামের পড়ে মুগদা এলাকায়। প্রাথমিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে বিজয়। তার পরিচিত কোনো দোকান আছে কি না জানতে চাইলে বিজয় জানায়, পরিচিত কারো দোকান নেই। আগুনে পানি দিতে আসছি। বিজয়ের বাবা হারুন রিকশাচালক। মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন।

বিজয়ের মতো আরো প্রায় ছয় থেকে সাত শিশু-কিশোরকে পাওয়া গেল ঘটনাস্থলে। তারাও আগুন নেভাতে সহযোগিতা করেছে।

দোকান মালিক সমিতির দাবি

আগুনে ছয়টি মার্কেটের ৫ থেকে ৬ হাজার দোকান পুড়ে গেছে বলে দাবি করেছেন বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনেক্সকো টাওয়ারের পরিচালক জহিরুল ইসলাম। গতকাল দুপুর ১টার দিকে তিনি এ কথা বলেন। জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের কোনো অবস্থা নেই। সব পুড়ে গেছে। ১০ হাজার মানুষ কর্মরত ছিলেন। ঈদের আগে সব দোকানে মালামাল তোলা হয়েছিল। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা বলা যাবে না।

বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মঙ্গলবার দুপুরে তিনি বলেন, এখানে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। টিনশেড মার্কেটের সব দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে রাজধানীর অন্যতম জনপ্রিয় পোশাকের এই বাজারে প্রায় আড়াই হাজার দোকান ছিল। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে দোকানদাররা অনেক টাকার মালামাল তুলে ছিলেন। সেখানে শাড়ি, শার্ট, প্যান্ট, সালোয়ার কামিজসহ সব ধরনের পোশাক বিক্রি হয়। হেলাল উদ্দিন বলেন, বিক্রেতারা ঈদ উপলক্ষ্যে কয়েকশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তবে, বঙ্গবাজারের দোকান মালিকদের কাছ থেকে এখনো ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।