নিজেকে আবিষ্কার করার সাধনা

প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

পবিত্র মাহে রমজানে যারা আল্লাহর হুকুম পালনে যত্নবান, তাদের জন্য বিশেষ পুরস্কার আল্লাহপাক তাদের অতীতের গোনাহগুলো মাফ করে দেবেন। রমজানের শুরু থেকে যারা আল্লাহর হুকুম পালনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, যারা ইবাদত-বন্দেগি, সৎপথে চলা, চিন্তা-বিশ্বাস ও বাস্তব কর্মে সততার স্বাক্ষর রাখছেন, পাপ অশ্লীলতা, মিথ্যা-কপটতা বর্জন করে চলেছেন, অনুমান করা যায় তারা আল্লাহর খাস রহমতের পরশ পেয়েছেন।

এশার নামাজের পর রাতের আঁধারে দেখা যায় খতমে তারাবিতে বয়স্ক লোকেরাও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনন্দচিত্তে আল্লাহর কালামের তেলাওয়াত শুনছেন, রুকুতে মহান রাব্বুল আলামিনের সামনে নত মস্তকে ঝুঁকে পড়ছেন, আবার উপলব্ধির গভীরতায় তারই সম্মুখে সিজদায় লুটিয়ে পড়ছেন, বসার পর বারবার জাহান্নাম থেকে নাজাত ও জান্নাতের সৌভাগ্য লাভের প্রার্থনা করছেন, তখন পরিবেশটাকে মনে হবে সম্পূর্ণ বেহেশতি এবং আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর মহব্বতের পরশে আপ্লুত।

এমন বান্দাদের উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে, ‘যারা রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে রোজা রাখে, তাদের অতীতের গোনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়।’ ‘যারা রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে রাত জেগে ইবাদত করে (সব মনীষীর মতে তারাবি নামাজ পড়ে) তাদের অতীতের গোনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়।’ (মিশকাত)।

আল্লাহ, আল্লাহর রাসুল, ফেরেশতাদের অস্তিত্ব, আসমানি কিতাবগুলো, পরকালীন জীবন ও তকদিরের ভালো-মন্দ লিখনের ওপর সংশয়হীন আস্থার নাম ঈমান। এর সঙ্গে আল্লাহর হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে ও সওয়াবের আশা নিয়ে রোজা রাখতে হবে। নচেত রোজা হবে উপবাসব্র্রত। দ্বিতীয় শর্ত ইহতিসাব। ইহতিসাব মানে কী। ইহতিসাবের মূল ধাতু হিসাব। নিজেকে হিসাব-নিকাশ করা, আত্মসমালোচনা, আত্মপর্যালোচনা করার নাম ইহতিসাব। তার মানে রমজান সাধনায় কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে হলে, অতীতের পাপতাপ মার্জনার মতো বিরাট পুরস্কার লাভ করতে হলে অবশ্যই আত্মসমালোচনা থাকতে হবে। নিজের কোথায় দোষ ও দুর্বলতা আছে খুঁজে বের করতে হবে এবং সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। তখনই মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবে।

দ্বীনের সব শিক্ষাদীক্ষায় বিশেষ করে সুফিতাত্ত্বিক সাধনায় এই আত্মআবিষ্কারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তুমি নিজের দোষ দেখ। পরের দোষ খুঁজতে যেও না। কথাটি বলা সহজ মনে হলেও কাজটি বড় কঠিন। কারণ, আমরা অন্যের দোষ চর্চা করে অনন্দ পাই। অপরের দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পারলে নিজেকে জ্ঞানী মনে করি। নিজের দোষ ও দুর্বলতার খবর আমাদের থাকে না। অথচ আমাদের ধর্মে অন্য মুসলমানের দোষ গোপন করাকে অনেক বড় সৎকাজ বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

ইবনে উমর (রহ.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে না তার ওপর জুলুম করে, আর না তাকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করে। যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে সচেষ্ট হয়, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের অসুবিধা (বিপদ আপদ) দূর করে দেয়, আল্লাহ এর বিনিময়ে কেয়ামতের দিন তার কষ্ট ও বিপদের অংশবিশেষ দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ গোপন রাখবেন। (বোখারি, মুসলিম)।

কেউ কোনো পাপ কাজ করল, আপনি তা দেখে ফেললেন। যদি ব্যক্তিগত বিষয় হয়, এর দ্বারা অন্য কারও ক্ষতি না হয় তাহলে শরিয়তের হুকুম হলো আপনি তার সেই পাপের কথা প্রকাশ করতে পারবেন না। করলে আপনি নিজেই পাপী হবেন। আর যদি গোপন করেন, আখেরাতে আল্লাহ আপনাকে বিনিময় দেবেন। তা হলো, আপনার দোষখাতা কেয়ামতের ময়দানে লক্ষকোটি মানুষের চোখ থেকে আড়াল করে রাখবেন।

বর্তমানে শোশ্যাল মিডিয়ায় কারো গুণের চেয়ে দোষ চর্চাই ভাইরাল হয়। ছোট্ট একটি ভুল বা দোষও সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তে। পরকালে মানুষের দোষত্রুটি লক্ষকোটি মানুষের সামনে প্রকাশ হওয়া ও লজ্জার কারণ হওয়ার ব্যাপারটি এখান থেকে অনুমান করা যায়।

শুধু অন্যের দোষখাতা নয়, অসতর্কভাবে নিজে কোনো পাপকাজ করে ফেললে সমাজের সামনে তা প্রকাশ করে দেয়া অমার্জনীয় অপরাধ।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি। আমার উম্মতের সবার গোনাহ মাফ হবে; কিন্তু দোষ-ত্রুটি প্রকাশকারীদের গোনাহ মাফ হবে না। দোষ-ক্রটি এভাবে প্রকাশ করা হয় : কোনো ব্যক্তি রাতের বেলা কোনো খারাপ কাজ করল। আল্লাহ তার এ কাজ গোপন রাখলেন। সে সকাল বেলা নিজেই বলবে, হে অমুক! আমি গতরাতে এই এই কাজ করেছি। অথচ রাত যাপন করেছিল এমন অবস্থায় যে, আল্লাহ তার কাজগুলো গোপন রেখেছিলেন আর সকাল বেলা আল্লাহর এই আড়ালকে সে সরিয়ে দিল। (বোখারি, মুসলিম)।

কাজেই অন্যের বা নিজের দোষ চর্চার ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকতে হবে। মওলানা রুমি (রহ.) এ ব্যাপারে অত্যন্ত সুন্দর একটি নীতিকথা বলেছেন : কোনো নির্দোষ লোকের সম্মানহানির চিন্তা যদি কারও মনে জাগে বুঝতে হবে, আসলে সেই লোককেই আল্লাহ আপমানিত করার ইচ্ছা করেছেন। তাই ভালো লোকটির পেছনে তাকে লাগিয়ে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে যদি আল্লাহর ইচ্ছা হয় কারো দোষ গোপন রাকবেন, দোষী লোকদের ব্যাপারেও সে নাক গলায় না।

চোন খোদা খাহাদ কে পর্দায় কাস দরদ

মেইলাশ আন্দর তা-নায়ে পাকান বরদ

খোদা যদি চান কারো সম্মানের পর্দা ছিন্ন করবেন

সৎ লোকদের দুর্নাম রটনায় তাকে লাগিয়ে দেন।

ওয়ার খোদা খাহাদ কে পূশদ আইবে কাস

কম যনদ দর আইবে মায়ুবান নাফাস

আর যদি খোদা কারো দোষত্রুটি গোপন করার ইচ্ছা করেন

দোষীদের ব্যাপারে কথা বলতেও সে নিঃশ্বাস সংবরণ করেন।

চোন খোদা খাহাদ কে মান ইয়ারী কুনদ

মেইলে মা রা জানেবে যারি কুনদ

আর যদি আল্লাহর ইচ্ছা হয় আমাদের সাহায্য করবেন

ক্রন্দনের দিকেই আমাদের আগ্রহ ধাবিত করেন।

(মসনবি শরিফ)