পদ্মা সেতুতে পরীক্ষামূলক ট্রেন

বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে অর্থনীতিতে

প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

অবশেষে পদ্মা বহুমুখী সেতুর রেললাইনে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলেছে। পরীক্ষামূলক বিশেষ ট্রেনটি ২০ মিনিটে পাড়ি দেয় সেতু। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের প্রায় ৯ মাস পর গতকাল মঙ্গলবার এই মাইলফলক রচিত হয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচলে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি মালবোঝাই ট্রেন চলবে। বেশিরভাগ ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। যার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন এক অধ্যায়। পুরোপুরি ট্রেন চালু হলে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে পদ্মা সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। গতকাল ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার মূল সেতু দিয়ে ট্রেন বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে পার হয়। আর মাওয়া স্টেশনে পৌঁছায় ৩টা ১৫ মিনিটে। বিশেষ ট্রেনটি ঘণ্টায় ২২ কিলোমিটার গতিতে পদ্মা সেতু পাড়ি দেয়। এর আগে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশনে দুপুর ১টা ২১ মিনিটে ট্রেনের যাত্রার উদ্বোধন করেন। ভাঙ্গা থেকে মাওয়া পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক এই ট্রেন সফরে রেলমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন জাতীয় সংসদে চিফ হুইপ নুর ই আলম চৌধুরী লিটন, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ইকবাল হোসনে অপু, সংসদ সদস্য মজিবুর হোসেন চৌধুরী নিক্সনসহ শতাধিক সাংবাদিক। পরে সাংবাদিকদের রেলমন্ত্রী বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা ট্রেন চলাচল করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেপ্টেম্বর মাসে যে কোনো একদিন সুবিধাজনক সময়ে ট্রেন চলাচলে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।

প্রথমবারের মতো চলা পরীক্ষামূলক ট্রেনের যাত্রী হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন রেলমন্ত্রীসহ সবাই। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনকারী পদ্মা সেতুতে গত বছরের ২৫ জুন গাড়ি চলাচল শুরু হলেও পরিকল্পনা মাফিক ট্রেন চলাচল শুরু করা যায়নি। তবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেতুতে নিয়মিত ট্রেন চলাচলের আশা প্রকাশ করেন নুরুল ইসলাম সুজন।

যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরসের নতুন ইঞ্জিনটি চীন থেকে আনা চকচকে লাল-সবুজ সাতটি বগিকে পরীক্ষামূলক যাত্রায় ধীর গতিতে টেনে নিয়ে পদ্মা পার করে। ট্রেনটির পেছনে আরেকটি ইঞ্জিন জুড়ে দেয়া ছিল। তবে এ লাইনে ইঞ্জিনটি সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে বলে জানান প্রকৌশলীরা।

চীনের ঋণ ও সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ঢাকার কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, ঢাকার কেরাণীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নড়াইল, মাগুরা হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার মূল লাইনসহ ২১৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে মাওয়া, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর এই তিন ভাগে প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাল ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত।

রেলমন্ত্রী সুজন বলেন, গত মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত এ প্রকল্পের সার্বিক ভৌত অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ। ঢাকা-মাওয়া অংশের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৭২ শতাংশ এবং মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি প্রায় ৯১ শতাংশ। ভাঙ্গা-যশোর প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে প্রায় ৬৮ শতাংশ। দুই তলা পদ্মা সেতুর উপরতলার সড়কপথ গত বছরের ২৫ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০ আগস্ট সেতুর নিচতলায় রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু হয়। সাত মাসের মাথায় গত ৩১ মার্চ সেতুর ওপর রেললাইন তৈরির কাজ শেষ হয়। এই রেললাইনটি পাথরবিহীন (ব্যালাস্টলেস), সেতুর পাটাতনের উপর ঢালাইয়ের মাধ্যমে স্লিপার বসানো হয়েছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্বের যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়। এর ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু এক্ষেত্রে অর্থনীতির ভিত্তি। সেতুতে মালবাহী ট্রেন চালু হলে অর্থনীতির সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে।

পদ্মা সেতু নিয়ে যে প্রাথমিক সমীক্ষা করা হয়েছিল, তাতে প্রাক্কলন করা হয়েছিল যে অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুণক ইতিবাচক প্রভাবে দেশের জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়তি সংযোজন হবে। রেল সংযোগের কারণে জিডিপিতে যুক্ত হবে আরো ১ দশমিক শূন্য শতাংশ। শুধু দ্রুততর যোগাযোগ, বিতরণ ও বিপণনের সুবিধার কারণে নয়, পদ্মা সেতু করিডোরের উভয় পাশে ব্যক্তি খাতের উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের যে সুযোগ সৃষ্টি হবে, তার সুবাদে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে বহুমাত্রিক প্রভাব। এরইমধ্যে সেতুকে ঘিরে রোডের দুইধারে বিভিন্ন শিল্প ও সেবা স্থাপনার সাইনবোর্ড দৃশ্যমান হচ্ছে। সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩ জেলায় ১৭টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার ও একাধিক শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। শুধু স্থানীয় বাজারমুখী নয়, রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রাথমিক পদক্ষেপও অনেক উদ্যোক্তা এরইমধ্যে গ্রহণ করছেন। এতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, জীবনযাত্রার মান উন্নতি হবে, বিশেষ করে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পণ্য ও সেবার সহজ চলাচলের কারণে ভোক্তা, উৎপাদক, রপ্তানিকারক, সেবা খাতকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আহরণের নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে; বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তির বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও রেল সংযোগ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে পদ্মা সেতু। যোগাযোগ সংযোগ, বিনিয়োগ সংযোগ ও বাণিজ্য সংযোগ এই ত্রিমুখী সংযোগের সার্থক সমন্বয়ে পদ্মা সেতু অর্থনৈতিক করিডোরের মূল কেন্দ্রবিন্দু।

পদ্মা সেতুর রেললাইনে ট্রেন চলাচলে রাজস্ব আহরণেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই সেতু থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর অর্থাৎ আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট উভয়ই আদায় হবে। তবে এই টাকা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।