নামাজের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য

প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

আমরা নামাজ পড়ি। নিয়মিত পাঁচ বেলা প্রার্থনা। আপন স্রষ্টা ও প্রতিপালকের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার আরাধনা। রমজানে এর চর্চা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। মনে কৌতূহল জাগল, অন্য ধর্মের লোকেরা কীভাবে তাদের স্রষ্টার উপাসনা করে। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেক কিছু সহজ। ব্রাউজ করে ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রার্থনা অনুষ্ঠান দেখার চেষ্টা করলাম। যা পেলাম তাতে আমার কাছে নতুনভাবে নামাজের সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হলো। কারণ, কোনো ধর্মেই আপন স্রষ্টা বা প্রভুর কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার জন্য নামাজের মতো সুন্দর আনুষ্ঠানিকতা নেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো বিবরণ না দিয়ে তরুণ সমাজকে বলব, কথাটি যাচাই করার জন্য নিজেরাও ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখুন। বুঝতে পারবেন, মুসলমান হিসেবে আমরা কত বড় সৌভাগ্যবান। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের কত বড় নেয়ামত আমাদের দিয়েছেন।

আমার অনুসন্ধানে আরও দুটি দিক স্পষ্ট হলো। একটি হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর উপাসনালয়গুলোতে ডিবুটিদের চরম দৈন্যতা। সেখানে দৈনিক পাঁচবার বা একবারও আনুষ্ঠানিক উপাসনার রেওয়াজ নেই। সপ্তাহে একদিন উপাসনালয়ে গিয়ে পুরোহিতের কাছে নিজের পাপ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করার প্রতিও দারুণ অনীহা। কারণ, এসব উপাসনালয়ে গিয়ে আত্মার খোরাক মিলবে এমন বিশ্বাস তারা হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে উপাসনাকারীর দৈন্যতায় উপসানলায়গুলো হাহাকার করছে। কোথাও কোথাও কিশোর ও তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য গির্জার চত্বরে খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একজন অভিজ্ঞ লোক বললেন, ব্রিটেনে উপাসনাকারীর অভাবে গির্জাগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরে মুসলমানরা সেগুলো ভাড়ায় বা ক্রয় করে নিয়ে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করছে এবং তা এখন রেওয়াজে পরিণত।

এর চেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, যেসব ধর্মে পুরোহিতদের চিরকুমার থাকতে হয়, বিয়ে করার বিধান নেই, সেসব ধর্মের পুরোহিতদের গির্জায় আশ্রিত অনাথ আশ্রম ও বিদ্যালয়গুলোর শিশু-কিশোরদের ওপর যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। যার বর্ণনা বিবিসির মতো পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে প্রায় সময় দেখা যায়।

পৃথিবীর সব ধর্মের মৌলিক শিক্ষা, দুনিয়াকে বর্জন কর, ভোগবিলাসিতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করো, তাহলে তোমার আত্মিক উন্নতি হবে। এ শিক্ষাকে বাস্তবরূপ দিতে গিয়ে বিভিন্ন ধর্ম মনগড়া পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, বৈরাগ্যবাদের জন্ম দিয়েছে। জীবনভর বিবাহ না করার মানব প্রকৃতিবিরোধী রেওয়াজ তারই একটি।

ইসলাম বলেছে, সংসার, ভোগবিলাসিতাকে জীবন থেকে সম্পূর্ণ বর্জন করা যাবে না; বরং সংসারের মধ্যে থেকে সংযমী জীবনযাপন করতে হবে। এর নাম তাকওয়া। নবীজি বলেছেন, ‘বিবাহ আমার সুন্নত, যে আমার সুন্নত বর্জন করল, সে আমার নয়।’ ইসলাম পার্থিব সুযোগ-সুবিধাকে সম্পূর্ণ দমন বা বর্জন নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলেছে এবং তাকে জীবনভর লালন করার জন্য পথ ও পদ্ধতি দিয়েছে। তার একটি নামাজ।

মুসলমান যখন নামাজে দাঁড়ায়, দুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে যায়। সবার মাঝে আছে, অথচ আল্লাহ ছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলতে পারে না। কোনো বৈধ খাবারও মুখে চিবাতে পারে না। এদিক-সেদিক তাকাতে পারে না। সালামের জবাবও দিতে পারে না। কোনো কাজে ব্যস্ত হতে পারে না। অর্থাৎ সাময়িকভাবে দুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন।

নামাজে যখন দাঁড়ায় ডান হাতের ওপর বাম হাত এমনভাবে বাঁধতে হয়, যেন নিজে নিজে হাতকড়া লাগিয়েছে। অপরাধীদের পুলিশ হাতকড়া লাগায়। নামাজিও যেন অপরাধী হিসেবে নিজেকে হাতকড়া পরা অবস্থায় আল্লাহর সামনে হাজির করেছে। এরপর মনের সবটুকু আকুতি আরজ করে আল্লাহর কাছে তারই শিখিয়ে দেয়া ভাষায় কেরাতে ও তসবিহ তেলাওয়াতে। তার চিন্তা, ধ্যানমগ্নতা ও উচ্চারণের দাবি অনুযায়ী তার অঙ্গভঙ্গিও বদলায়। আল্লাহর মহানত্বের চেতনা যখন প্রবল হয়, তার সামনে নতমস্তকে ঝুঁকে পড়ে রুকুতে। রুক থেকে ওঠার সময় উপলব্ধির চেতনায় বলে, আমি যে আল্লাহর প্রশংসা করেছি তিনি তা শুনেছেন। রুকুতে উপলব্ধি করে আল্লাহর সত্তা শুধু বিশাল মহান নয়, তিনি অতি উচ্চও। এমন অতিউচ্চ মহামহিম প্রভুর সামনে বান্দার মাটিতে সিজদায় লুটিয়ে পড়া ছাড়া আর কী করার আছে। রুকুতে বলেছিল, আমার মহান আল্লাহ অতিশয় পবিত্র। সিজদায় তার হৃদয় নিংড়ানো উচ্চারণ ‘আমার সুউচ্চ মহিয়ান আল্লাহ অতিশয় পবিত্র, আমি তার পবিত্রতা বর্ণনা করছি।’

মওলনা রুমি বলেন, ‘সিজদা মানে নিজের ব্যক্তিত্ব, আত্মপরিচয় ও অহংকার বলতে যা বুঝায় তা একে একে ছুড়ে ফেলা। তারপর আল্লাহকে বলা, আমি তোমার বান্দা, অনুগত দাস।’ কোরআন মজিদে এ জন্যই বলা হয়েছে ‘তুমি সিজদা কর আর সান্নিধ্য অর্জন কর।’ নামাজে আল্লাহর সান্নিধ্যের এই অনুশীলন প্রথম থেকেই শুরু হয়। আমাদের সুরা ফাতেহা পাঠ যেন মহান আল্লাহর সঙ্গে আলাপন।

আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, অনাদি অনন্ত দয়াময় আল্লাহ, যাঁর শান ও জালাল মহিমান্বিত, যাঁর নামগুলো পবিত্র, যাঁর গুণাবলি অতি মহান, তিনি বান্দার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে মহানুভবতা হেতু বলেন, নামাজকে আমি আমার ও আমার বান্দার মাঝে ভাগ করে নিয়েছি। তাতে অর্ধেক আমার, আর অর্ধেক আমার বান্দার অংশ। আমার বান্দার জন্য রয়েছে যা সে চায়। অতএব বান্দা যখন বলে, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ (আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি দয়াময়, পরম দয়ালু) তখন আল্লাহ বলেন, বান্দা আমার নাম উল্লেখ করেছে এবং আমাকে সুন্দর নামে ডেকেছে। বান্দা যখন বলে ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎগুলোর প্রতিপালক) তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার তারিফ প্রশংসা করেছে। আর যখন বান্দা বলে ‘আর রহমানির রাহিম’ (তিনি পরম দয়াবান, অতিশয় দয়ালু) তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার যথার্থ প্রশংসা ও গুণগান করেছে। বান্দা যখন বলে, ‘মালিকি ইয়াউমিদ দীন’ (বিচার দিনের মালিক) তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার মহানত্ব ও পবিত্রতা ঘোষণা করে আমাকে সম্মানিত করেছে। সে আমার ওপর ভরসা করেছে। তার কাজ আমার ওপর সোপর্দ করেছে। সে জেনেছে যে, আমিই তার কাজকর্মের সুন্দর ব্যবস্থাপক। আমিই তার প্রতি সৌভাগ্যগুলো পূর্ণ মাত্রায় প্রদানকারী। আমিই তার কার্যাবলি সুসম্পন্নকারী ও তার জীবিকার ব্যবস্থাকারী। সে আমার দিকে তার অসহায়ত্বের হাত বাড়িয়েছে। বলেছে ‘ইহদিনা’ আমাকে পথ দেখাও... সুরার শেষ পর্যন্ত আমার বান্দার দোয়া আর সে যা চেয়েছে সবই তাকে দেয়া হবে।’

(মুসলিমের বরাতে তাফসিরে কাশফুল আসরার)