বেড়েছে বিদ্যুতের দাম, কমেনি লোডশেডিং

গরমে চরম দুর্ভোগে মানুষ

শহরের তুলনায় গ্রামে লোডশেডিং বেশি

প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশে এক বছরে কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও লোডশেডিং নিরসন হয়নি। গরমে ফ্যান ও এসির ব্যবহার শুরু হতেই বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ঢাকার বাইরে দিনে-রাতে কয়েক দফায় লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং শুরু হয়েছে, এটি বলা যাবে না। যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যে আছে, সেসব এলাকায় বিদ্যুতের লাইন মেরামত ও সংযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। তবে গত মঙ্গলবার ময়মনসিংহ এলাকায় ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জ্বালানি সংকটে চলমান বিদ্যুৎ ঘাটতি পুষিয়ে ওঠা বেশ কঠিন। সেজন্য দিনে-রাতে লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। আগামীতে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরো বাড়তে পারে। এরই মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চল, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেটে লোডশেডিং বেড়েছে।

দেশের সার্বিক আর্থিক অবস্থা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ সমন্বয় (বাড়ানো) করা হয়। লাইফ লাইন গ্রাহকদের ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সার স্থলে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ ইউনিটপ্রতি ১৯ পয়সা বেড়েছে। লাইফ লাইন গ্রাহক রয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বল্পতার কারণে আমদানি করা তরল গ্যাসের ব্যাপক ব্যবহার, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকা মানের অবমূল্যায়নের ফলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গত বছরের ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ২০ শতাংশ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে। বিতরণ কোম্পানিগুলো পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ২০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে তাদের আর্থিক ক্ষতি পূরণের জন্য অন্তত ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ খুচরা বা ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছে।

বিউবোর চট্টগ্রাম বিভাগের সম্ভাব্য লোডশেডিং শিডিউলে দেখা গেছে- চট্টগ্রামের রসুলবাগ, কাপাসগোলা ও রাহাত্তরপুল এলাকায় দিনে-রাতে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের শিডিউল করা হয়েছে। একই অবস্থা চান্দগাঁও থানা, নুরনগর ও ওয়াজের পাড়াসহ পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে। তবে বান্দরবান ঘোনাপাড়া, কলেজ রোড, নতুন পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় দিনে-রাতে ২ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের শিডিউল করা হয়েছে। লোডশেডিংয়ের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উত্তরাঞ্চলে। সেখানে নির্ধারিত সময় ছাড়াও যখন-তখন লোডশেডিং চলমান রয়েছে। ময়মনসিংহ এলাকায় চলতি মাসের ১৫ দিনের লোডশেডিংয়ের শিডিউল করা হয়েছে। শিডিউল অনুযায়ী সারা দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং চললেও বিদ্যুৎ বিভাগ দাবি করছে, চাহিদা অনুযায়ীই বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

সিলেট বিউবো’র বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলীর স্বাক্ষরিত লোডশেডিং শিডিউলে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, রক্ষণাবেক্ষণ এবং লোড প্রাপ্তি সাপেক্ষে শিডিউল পরিবর্তন হতে পারে। সিডিউলের মাধ্যমে নিয়মিত লোডশেডিংয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ময়মনসিংহের ভালুকা বিউবো’র বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। লোডশেডিংয়ের একই অবস্থা সারা দেশে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) রমজান মাসে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি থাকলেও উত্তরাঞ্চল, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং করা হয়েছে। এ বিষয়ে পিডিবি বলছে, গরম মৌসুমে রমজানের সঙ্গে সেচ মৌসুমও শুরু হয়েছে। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। রমজান, সেচ ও গরম একসঙ্গে হওয়ায় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড ছাড়াতে পারে। এই সময়ে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। তাই দেশের বিভিন্ন জেলায় লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে।

গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বাসিন্দা আফরুজা বেগম বলেন, রোজার মধ্যেও দিনে-রাতে বিদ্যুৎ থাকছে না। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর কখন আসবে তা কেউ জানে না। আকাশে মেঘ হলেও অনেক সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। এভাবেই চলছি আমরা।

লোডশেডিংয়ের ঘটনা শুধু গাইবান্ধা নয়, চট্টগ্রামের রসুলবাগ এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, দিনে-রাতে তিন চার বার বিদ্যুৎ যায়। প্রতিদিনই একই ঘটনা। আর বিদ্যুৎ কখন যাবে কখন আসবে এর ঠিক নেই। ফলে কলকারখানা চালানো, দোকান চালানো, বাচ্চাদের পড়ালেখা সব কিছুতেই সমস্যা হয়। তারপরও আমরা মানিয়ে নিয়ে চলি। একই ধরনের অভিযোগ সিলেট বড়শালার বাসিন্দারা বলেন, লোডশেডিং হতেই থাকে। আমরা মাঝে মাঝে স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে ফোন দিলে তারা নানা রকম অজুহাত দিতে থাকে। অনেক সময় সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ গিয়ে সারা রাত আসলোই না। কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের মতো সাধারণ মানুষই শুধু ভোগান্তির শিকার হয়।

নীলফামারীতে এলাকা প্রতি এক ঘণ্টা লোডশেডিং হওয়ার কথা থাকলেও পুরো চিত্রই আলাদা। বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্রুপ অনুযায়ী এক ঘণ্টা লোডশেডিং করে আবার দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে।

অর্থাৎ পিডিবি এবং পিজিসিবি যাই বলুক না কেন লোডশেডিং রয়েই গেছে। রাজধানীসহ সারাদেশে গত বছর লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছিল মানুষ। প্রথমে সিডিউলভিত্তিক লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেয়া হলেও দিনের অর্ধেক সময়ই বিদ্যুৎ বিহীন অবস্থায় কাটাতে হয় গ্রাহকদের। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে এ পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ভয়াবহ। সেখানে ৫-৬ ঘণ্টা পর পর একবার করে বিদ্যুৎ আসত কয়েক মিনিটের জন্য। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল ঘাটতির কারণেই এমনটি হচ্ছিল।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গরম ও সেচ মৌসুমকে সামনে রেখে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা গিয়ে পৌঁছাতে পারে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের। এর বিপরীতে রামপাল, পায়রা, আদানি, বরিশালসহ কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতিদিন অন্তত সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এর বাইরে গ্যাস চালিত কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদিত হবে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। একইভাবে ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক কেন্দ্রগুলো উৎপাদন করবে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর বাইরেও সৌরবিদ্যুৎসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস থেকেও কিছু বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গত বছরের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এবার রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। সেই রোডম্যাপ অনুযায়ী সব ঠিকঠাক চলছে। তবে গত মঙ্গলবার ময়মনসিংহ এলাকায় ২০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় যে লোডশেডিং চলছে, সেটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সমস্যার কারণে হতে পারে বলে জানান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক।