ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজধানীতে আগুন নেভাতে পানির সংকট

জলাধার ভরাটে বিপাকে ফায়ার সার্ভিস

জলাধার ভরাটে বিপাকে ফায়ার সার্ভিস

রাজধানীজুড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিনিয়ত পানি সরবরাহে বড় ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। রাজধানীর খাল, ডোবা ও নালা অবৈধভাবে ভরাট হয়ে যাওয়ায় আগুন নেভাতে গিয়ে পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না ফায়ার সার্ভিস। এতে বছরের পর বছর অগ্নিকাণ্ডে শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। সেইসঙ্গে বিপুল সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। অথচ মুঘল আমলে রাজধানী ঢাকার চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল খাল ও ডোবা। নৌকা, স্টিমার চলতো খালে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ ছিল ঢাকা। প্রবাহমান নদী ও খালের সুবিধা থাকায় মুঘলরা ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত হয়েছিল। সম্প্রতি এসব খাল ও ডোবা দখল-দূষণে সংকটাপন্ন হওয়ায় আগুন নেভাতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে ফায়ার সার্ভিস।

গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের পুকুরের পানি ব্যবহার করে ফায়ার সার্ভিস। হলের পুকুরে আটটি পাইপ লাগিয়ে পানি নেওয়া হয়। ফজলুল হক হলের পুকুর ছাড়াও সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল এবং পুলিশ প্লাজার পানির লাইন থেকেই পানি নেওয়া হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন হয়, যা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির মাধ্যমে বহন করা সম্ভব হয় না। সেজন্য যে ভবনে আগুন লাগে তার আশপাশের পুকুর বা জলাধার থেকে পানি সংগ্রহের ওপর জোর দেওয়া হয়। জানা গেছে, ঢাকার নিমতলী, তাজরীন ফ্যাশন, হাসেম ফুড, চকবাজারের চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে শত শত মানুষ মারা যায়। এবার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পাশেই বঙ্গবাজার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ীদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাঁই হয়েছে। বঙ্গবাজার মার্কেটের কাছ দিয়ে এখনও যারা চলাচল করছেন তাদের নাকে ছাঁইয়ের গন্ধ লাগছে।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকায় ৭৩টি খাল রয়েছে। ২০১৬ সালে করা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ বলছে, খালের সংখ্যা ৫৮টি। উল্লিখিত খালের ৩৭টিতেই দখলদার রয়েছে। দখল ও দূষণে খালের স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। কোনো কোনোটি পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে। খাল, ডোবা ভরাট হওয়ায় বৃষ্টির মৌসুমে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি কোনো ভবনে আগুন লাগলে পানির সংকটে পড়তে হয়। মঙ্গলবারের আগুনে বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর নিজস্ব গাড়ি, ঢাকা ওয়াসার ১৪০ গাড়ি, হাতিরঝিল থেকে বিমানে নেওয়া পানির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলসংলগ্ন পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়।

আগুন নিয়ন্ত্রণের পর গণমাধ্যমকর্মীদের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেছিলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময়ে উৎসুক জনতা, পানির স্বল্পতা ও বাতাসের কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে। রাজধানীতে যতবারই এমন বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে, ততবারই আলোচনায় আসে আগুন নেভানোর জন্য পানির উৎস নিয়ে। তবে তারপর সব আলোচনা থেমেও যায়।

প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ আইনসহ বিভিন্ন আইন থাকার পরও জলাশয় কমতে কমতে কেন্দ্রীয় ঢাকায় ৫ থেকে ৬ ভাগে নেমে এসেছে জানিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই রাজধানীতে জলাধার ছিল, যা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে নির্বিচারে ভরাট করেছেন। বর্তমানে মিরপুর ও কল্যাণপুর জলাধার ভরাট করা হচ্ছে, সিটি করপোরেশন জলাধার ভরাট না করতে নোটিশও দিয়েছে, কিন্তু এরপরও ভরাট চলছে।

তিনি আরও বলেন, সরকার বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প নিচ্ছে। অথচ নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর রাজধানীতে হাইড্রেন্ট স্থাপনের আলোচনা হয়েছিল। হাইড্রেন্ট স্থাপনে সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের দায়ভার সিটি করপোরেশন ও ব্যবসায়ি উভয়ের রয়েছে।

মহানগরে জলাধার, মাঠ ও উদ্যান সংরক্ষণে ২০০০ সালে প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ আইনটি করা হয়েছে। আইনে প্রাকৃতিক জলাধার বলতে নদী, খাল, বিল, দিঘি, ঝরনা বা জলাশয় হিসেবে মাস্টার প্ল্যানে চিহ্নিত বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা কোনো সংস্থার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বন্যাপ্রবাহ এলাকা ঘোষিত কোনো জায়গা এবং পানি ও বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমিকেও বোঝানো হয়েছে। আইন ও নীতিতে পরিবেশবান্ধব মহানগরীতে জলাধার রাখার নির্দেশনা দেওয়া আছে। আইন ও নীতিমালা থাকার পরও পুকুর ও জলাধার ভরাটের মহোৎসব চলছেই।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ২০১৯ সালে ঢাকা ও এর চারপাশের জলাশয় ভরাটের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, মহানগর এলাকায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় থাকা উচিত। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি ঢাকা থেকে হারিয়ে গেছে।

স্থপতি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, বঙ্গবাজারের ১০০ গজ দূরে ওসমানী উদ্যানে উন্নয়নের নামে পুকুরটি শুকনা খটখটে হয়ে পড়ে আছে। বঙ্গবাজারের আগুন নেভাতে এটিকে পানির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা গেল না। নিমতলী ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থা ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের সুপারিশ করে আসছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। কিন্তু আজও নগরীতে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন হয়নি। এর জন্য ফায়ার সার্ভিস দুষছে সিটি করপোরেশনকে। কারণ নগর গোছানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে এ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।

রাজধানীতে আগুনে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব এমন মন্তব্য করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ঢাকার উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মা আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে যে পানি নিয়ে যাওয়া হয়, সেই পানি ছিঁটালে আগুন দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু যখন বেশি পানি দরকার, তখন খাল ও ডোবা থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। বঙ্গবাজারের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে পানির স্বল্পতার জন্য। অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়েছে। আশপাশে পুকুর, ডোবা, জলাশয় থাকলে কাজটা সহজ হতো। ঢাকা শহরে এখন পুকুরের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। ওয়াটার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থাও চালু করা সম্ভব হয়নি। সব মিলে আগুন লাগলে তা নেভানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

দিনমনি শর্মা বলেন, রাজধানীতে রাস্তার ওপর ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। এটি ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর করতে পারে না। কিন্তু সিটি করপোরেশন হাইড্রেন্ট বসানোর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। আমাদের পাশের দেশ ভারতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে রাস্তার কোথাও ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই। কোনো এলাকায় আগুন লাগলে স্থানীয় ভবনের রির্জাভ টাংকি থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে হয়। পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের মাঝে এক ধরনের সংশয় কাজ করে। এতে কাজের ক্ষেত্রে চাপের মুখে থাকতে হয় আমাদের। কারণ ফায়ার সার্ভিসের তো পানি দরকার। তিনি আরও বলেন, ‘জলাধার ভরাট করা যাবে না, সেটি আইনে আছে। কিন্তু সেই আইন কেউ মানছে না। সিটি করপোরেশনের সামনেই ওসমানী উদ্যানে ডোবা ছিল, সেই ডোবা ভরাট করা হচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলী আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। নিমতলীর দুই বছর পর তাজরীন ফ্যাশনে আগুনে পুড়ে মারা যায় ১১৭ জন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানায় ৫১ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন, একই বছরের ২৮ মার্চ বনানী এফআর টাওয়ারে ২৭ জন। মাত্র কয়েক বছরে এসব অগ্নিকাণ্ডে শত শত মানুষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত