ইসলামি সমাজব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি রমজান

প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

‘স্যার, আমার মতো অনেক তরুণ আছে, আমরা মুক্তচিন্তার ফোরামে যাই। তখন কিছুক্ষণের জন্য মন ও চিন্তাকে ধর্মীয় বা সামাজিক বাঁধনের বাইরে নিয়ে যাই। আমাদের চিন্তায় থাকে মানুষ ও সমাজ। কারণ, সমাজের বদ্ধমূল প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস আমাদের অগ্রসর হতে দেয় না। পেছনে পড়ে থাকতে হয়।’ কথাটি ছিল একজন তরুণ সহকর্মীর।

তিনি আরো বললেন, ধরুন, আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করি না। নবীজির কথাও মানি না, তাকে জানি না। যারা কোরআন-হাদিস বিশ্বাস করে তাদের জন্যই তো ধর্ম। আমাকে কেন ধর্ম মানতে হবে। আমি বুঝি আমার সমাজ, সমাজের মানুষ। ধর্মীয় বিশ্বাস আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায়। তিনি আরো একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, আমাদের ধর্মে বলা হয়েছে, কোনো প্রাণী জবাই করার সময় আল্লাহর নাম নিলে খাওয়া বৈধ, আল্লাহর নাম উচ্চারণ না করলে খাওয়া হারাম, এর পেছনে কী যুক্তি আছে। ধৈর্য ধরে তার কথাগুলো শুনলাম। ধর্মীয় আবহের বাইরে থাকা তরুণদের মনে কীসব প্রশ্ন ভিড় করে বুঝতে চেষ্টা করলাম।

বললাম, ধর্ম ও ধর্ম বিশ্বাসকে দূরে রেখে কিছুক্ষণের জন্য মানুষ ও সমাজ নিয়ে চিন্তা করি। ধরুন, একটি বিরাট জনপদ। তাদের নিয়ে আপনি কাজ করতে চান। তাদের জীবনমান উন্নয়ন আপনার জীবনের সাধনা। এই জনপদের জন্য তো কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলা লাগবে। নচেত হানাহানি অরাজকতা ও স্বার্থের সংঘাতে অশান্তির আগুন জ¦লবে। সমাজ উন্নয়নের জন্য একটি সমাজ-শৃঙ্খলার কথা আমি বলছি, শুনুন।

একটি সমাজে মানুষকে ভালো-মন্দ, বৈধ-অবৈধ চেনার ও পলন করার নীতিমালা শিক্ষা দেয়া হয়। আপন স্রষ্টায় বিশ্বাস ও তাঁর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য দৈনিক পাঁচবেলা এক জায়গায় জড়ো করা হয়। তখন সমাজের লোকদের মধ্যে পরস্পর শান্তি কামনা, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বাতাবরণ তৈরি হয়। পাঁচবেলা প্রার্থনার প্রয়োজনে প্রত্যেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি যত্নবান হয়। একটা মিটিংয়ে মানুষ জোগাড় করতে কত কসরত করতে হয় : অথচ নৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক বন্ধন ও স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণের এই আয়োজন হয় পবিত্র চেতনায়, নিঃস্বার্থভাবে।

সপ্তাহে একবার সমাজের মানুষেরা একজন ধর্মীয় নেতার নির্দেশনায় প্রার্থনা সভায় মিলিত হয়। তার উপদেশ ও বক্তৃত শুনে। পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ, পরিচয় ও সলাপরামর্শের একটি সুন্দর আয়োজন থাকে। বছরে দুটি উৎসব পালন করে পবিত্র চেতনায়। নৈতিক শুদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য সর্বজনীন কৃচ্ছ্রসাধনার আয়োজন থাকে বছরে এক মাস একটানা। সমাজের কিছু লোক সংসার বিরাগী হয়ে নৈতিক উৎকর্ষতায় সাধু-সৈন্ন্যাসী হওয়া যায়। কিন্তু সমাজের সবার জন্য এক মাসের কৃচ্ছ্রসাধনার মূল্য অপরিসীম। ধনী-গরিবের ব্যবধান দূর করে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টির জাকাত, সদকা, ফিতরা ও অনুদানের ব্যবস্থাও সেই সমাজে বলবৎ আছে। আপনারা মুক্ত চিরতরুণরা কি এ ধরনের একটি আদর্শ সমাজের কথা চিন্তা করতে পারেন না? আল্লাহ, রাসুল, কোরআন বা ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলেও ইসলাম কল্যাণধর্মী আদর্শ সমাজের যে রূপরেখা দিয়েছে, আপনারা মুক্তচিন্তার তরুণরা কী এর চেয়ে সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার ফর্মুলা দিতে পারেন। নিশ্চয়ই না।

বললাম, একটি জনপদের কথা চিন্তা করুন। যেখানকার পানির একমাত্র উৎস পাড়ার মাঝখানের একটি পুকুর। দীর্ঘদিন অযত্নে-অবহেলায় কচুরিপানার দঙ্গল তৈরি হওয়ায় পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফলে পানির অভাবে সমস্যার অন্ত নেই। উদ্যমী তরুণরা কচুরিপানা পরিষ্কার করে হাজামজা পুকুরটি ব্যবহার উপযোগী করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কিন্তু ভাঙা পাড় দিয়ে নালানর্দমার ময়লা পানি আবর্জনা এসে পুকুর ভরে যায়।

গ্রামের বৃদ্ধ মুরব্বি বললেন, বাবারা! যেভাবে পুকুর পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন, সফল হবেন না। তার জন্য সম্মিলিত উদ্যেগ প্রয়োজন। তার কথা মতো প্রথমে পুকুরের সঙ্গে যুক্ত পাঁচটি নালা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হলো। তরুণরা এর পর হল্লা করে কচুরিপানা তুলে ফেলল পুকুর ছেঁকে। তারপর পচা পানি বের করার ব্যবস্থা হলো। পানি তোলার পর নিচের পলিমাটি খনন করা হলো। তারপর পুকুরের তলা শুকাতে দেয়া হলো সূর্যের প্রখর রোদে। পরক্ষণে খননকাজ করা হলে দেখা গেল, পাতাল থেকে উথলে উঠছে স্বচ্ছ নির্মল স্ফটিকের মতো পানি। দেখতে দেখতে পুকুর ভরে গেল। বৃদ্ধ বললেন, এবার পুকুরের পাঁচটি নালা খুলে দাও। লোকালয়ে পানি প্রবেশ করুক। অনেক দিন পর সুপেয় পানি পেয়ে পুরো জনপদ নতুন জীবন নিয়ে জেগে উঠল। চারদিকে আনন্দের হিল্লোল।

বৃদ্ধ বুঝিয়ে বললেন, আমাদের দেহের পুষ্করণীতে পাঁচটি নালা আছে, চোখ, কান, নাক, ত্বক, জিহ্বা। সারা বছর এই নালা দিয়ে দুনিয়ার আবর্জনা ঢুকে আমাদের অস্তিত্বের পুকুরের পানি আবর্জনায় ভরে দিয়েছে। তাকে পরিষ্কার করার পথ ছিল, সাময়িকভাবে পাঁচ ইন্দ্রিয়ের কার্যক্রম বন্ধ রাখা। একটানা এক মাস দিনের বেলা খেতে পারবে না। খারাপ কিছু দেখতে বা শুনতে পারবে না। মনকে মন্দ ও অসুন্দর চিন্তা থেকে পবিত্র রেখে তারপর ভেতরের কচুরিপানা পরিষ্কার করতে হবে। খননকার্য চালাতে হবে ইবাদতের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে। এরপর রুহের পাতাল থেকে যা কিছু বের হবে, তার ফল্গুধারা তোমার চরিত্রে প্রতিভাত হবে। তার প্রভাবে গোটা সমাজ আলোকিত ও উদ্ভাসিত হবে।

তরুণ চিন্তকের প্রশ্ন ছিল, ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার যে চিত্র, বাস্তবে সেখানেও তো অন্যায় হয়। বাহ্যত ধার্মিক লোকেরাও অন্যায় কাজে জড়ায়। বললাম, ইসলামি সমাজ মানে সেই সমাজে অন্যায়-পাপ করা কঠিন হয়ে যাবে। ভালো ও ন্যায়ের পথে চলার পরিবেশ সহজ হবে। সমাজের সব মানুষ ফেরেশতা হয়ে যাবে- এমনটি যুক্তির দাবি নয়। ‘রমজানে আল্লাহর ফেরেশতারা ডাক দিয়ে বলেন, হে কল্যাণের সন্ধানী এগিয়ে এসো এবং হে মন্দের প্রতি আগ্রহী তুমি পেছনে হটে যাও- হাদিসের এ বাণীর তাৎপর্য এটিই।

বিশাল খামারের মালিক ঘোষণা দিলেন, আমার ক্ষেতের ফলমূল সর্র্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। তবে শর্ত হলো, আমার অনুমতি নিতে হবে, আমাকে জানাতে হবে। কেউ যদি মালিকের অনুমতি না নিয়ে ফলমূল তুলে নেয়, নিশ্চয় তা অবৈধ হবে, যে কাজ আপনারা কখনো সমর্থন করবেন না। আল্লাহতায়ালাও বলেছেন, তোমাদের জন্য প্রাণিজগতের অনেকগুলো হালাল করে দিয়েছি। তবে আমার অনুমতি নিলেই বৈধ হবে। জবাইর সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা আল্লাহর কাছ থেকে অনুমতি নেয়ারই নামান্তর।