তিন দিনেও নিভেনি বঙ্গবাজারের আগুন

হামলা-কাজে বাধা দেয়ায় মামলা আসামি ৩০০, রিমান্ডে তিনজন

প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

রাজধানীর বঙ্গবাজারের আগুন তিন দিনেও নির্বাপণ করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত সর্বশেষ খবর অনুযায়ী- ফায়ার সার্ভিসের ২টি ইউনিট বঙ্গবাজার এলাকায় কাজ করছিল। আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদও।

অন্যদিকে, বঙ্গবাজারে অগ্নিনির্বাপণের সময় পুলিশের ওপর হামলা ও কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বংশাল থানায় বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করে পুলিশ। গতকাল বিকাল নাগাদ ওই মামলায় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ বলেন, আগুন এখনো সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা যায়নি। দুইটি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করছে। আগুন নির্বাপণ হলে আমরা জানিয়ে দিব। আমরা মূলত এখন ডাম্পিংয়ের কাজ করছি। আগুনের ধ্বংসস্তূপ সরানোর সময় নিচ থেকে আবারও কিছু জায়গায় ছোট ছোট আগুন জ্বলে উঠছে। পরে সেসব আগুন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নির্বাপণ করছেন। ছোট আগুনগুলো নেভানো গেলে ফায়ার সার্ভিস সম্পূর্ণ নির্বাপণ ঘোষণা করবে। এ বিষয়ে ঘটনাস্থলে কর্মরত ফায়ার ফাইটাররা বলছেন, বঙ্গবাজার মার্কেটে এখন আর আগুন নেই। মাঝে মধ্যে অল্প ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। তবে এনেক্সকো টাওয়ারের ৫ তলায় মালামাল সরানোর সময় ছোট ছোট আগুন দেখা যাচ্ছে। সেগুলো আমরা নেভানোর চেষ্টা করছি।

সরেজমিনে এনেক্সকো টাওয়ারে দেখা যায়, আগুন লাগার তৃতীয় দিনেও সেখান থেকে পোড়া ও বেঁচে যাওয়া মালামাল সরানো হচ্ছে। কেউ কেউ ওপর থেকে মালামাল নিচে ফেলছেন, আবার কেউ মাথায় করে নিচে নিয়ে আসছেন। তবে অধিকাংশ কাপড়ই পুড়ে গেছে। আর সেসব কাপড়ের স্তূপ জমছে ভবনটির সামনে। এই পোড়া কাপড়ের স্তূপ থেকে তুলনামূলক কম পোড়া কাপড় নিজেদের জন্য নিচ্ছে হতদরিদ্র মানুষজন।

এনেক্সকো টাওয়ারের ভেতরে চলা বর্তমান কার্যক্রম নিয়ে ভবনটির নিরাপত্তা কর্মী মো. সালাম বলেন, পাঁচ তলায় এখনো ধোঁয়া উঠছে, আবার মাঝে মধ্যে আগুনও জ্বলে উঠছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন নেভানোর চেষ্টা করছে। তবে পানির সংকট থাকায় সময় বেশি লাগছে। এছাড়া মার্কেটের ব্যবসায়ীরা নিজেদের দোকান পরিষ্কার করছেন। ভিতরে থাকা ভালো এবং পোড়া মালামাল বের করে নিয়ে আসছেন অনেকে।

এদিকে বঙ্গবাজার মার্কেটের এক পাশের রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে পুলিশ। এর ফলে এনেক্সকো মার্কেটের সামনে থেকে বঙ্গবাজার মার্কেটগামী রাস্তাটিতে চলাচল বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সকাল ১১টার দিকে বঙ্গবাজার মার্কেটের ধ্বংসস্তূপ থেকে অনেক মানুষ পোড়াকাপড়, টিন-লোহা ও বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ নিয়ে যাচ্ছিলেন। পরে শাহবাগ থানা পুলিশ এসে সবাইকে সরিয়ে দিয়েছে এবং মার্কেট এলাকায় সর্বসাধারণের যাতায়াত সীমিত করেছে।

এ বিষয়ে শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল্লাহ বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে সর্বসাধারণের যাতায়াত সীমিত করার জন্য এই ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। সকলের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে এই কাজ করা হয়েছে।

তালিকা করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা হবে : গতকাল সকালে বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডস্থল পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এসময় তিনি বলেছেন, বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় ৩-৪ দিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে সহযোগিতা করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ঈদের আগেই ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ করে দেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

সালমান এফ রহমান আরও বলেন, ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার জন্য আমাকে ফোন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। আর্থিক অনুদানের জন্য একটি যৌথ ব্যাংক হিসাব, বিকাশ, নগদ, রকেট অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দিয়েছি। অ্যাকাউন্টগুলো খোলার পরে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে।

তালিকায় নাম লেখাতে ক্ষতিগ্রস্তদের উপচেপড়া ভিড় : বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করতে তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। বুধবার বিকালে বঙ্গমার্কেটের পাশের এনেক্সকো টাওয়ারের সামনে একটি অস্থায়ী তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করে প্রশাসন। এসময় কয়েকশ ক্ষতিগ্রস্তকে হাতে দোকানের ভিজিটিং কার্ড, ক্যাশ মেমো ও এনআইডি কার্ড নিয়ে তালিকায় নাম লেখাতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

হাতে দোকানের ক্যাশ মেমো নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরিফুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, শুনেছি এখানে নাম লেখালে সহায়তা পাওয়া যাবে। তাই নাম লেখাতে এসেছি। জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সায়েম ইমরান বলেন, প্রাথমিকভাবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্রে একজন ব্যবসায়ী তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম লিপিবদ্ধ করতে পারবেন।

‘আত্মীয়স্বজনের ইফতারি-খাওন দিয়া ক’দিন চলুম’ : রাজধানীর বঙ্গবাজারে আগুন লাগে মঙ্গলবার। তৃতীয় দিনে এসেও আগুনে পুড়ে যাওয়া দোকানের কাছে এসে বিলাপ করে কান্না করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা ইফতারি ও খাবার দিচ্ছেন। সঙ্গে সান্ত¡না। কিন্তু এই সান্ত¡না দুইদিনের। আমাদের পুনর্বাসন করে ব্যবসা শুরু করতে দিলে আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারব। হাসিবুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী পুড়ে যাওয়া কাপড় দেখিয়ে বলেন, এগুলো তার দোকানের মালামাল। ঈদ উপলক্ষ্যে শিশুদের পোশাক তুলেছিলেন তিনি। তার দোকানে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। শাহীনুর রহমান কান্নারত অবস্থায় বলেন, তার দোকানে আগুন লাগার তিনদিন আগে ২৫ লাখ টাকার মালামাল উঠিয়েছিলেন। আশা ছিল ঈদে বিক্রি হবে এবং সেই লাভের টাকা দিয়ে গ্রামে কিছু জমি রাখবেন। আফজাল শেখের দোকান ছিল বঙ্গবাজার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায়। তিনি বলেন, এমনভাবে পুড়বে তা কোনোদিনও ভাবেননি। মানুষের দোকানে আগুন লাগে। কিন্তু আগুনে যে সব শেষ হয়ে যাবে, কে ভাবছে? ইকবাল নামের আরেক ব্যবসায়ী তার দোকানের তালা দেখিয়ে বলেন, দোকানের লাখ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে, ক্যাশ বাক্স পুড়েছে। দোকানে দেয়া স্টিলের তালা এখনো অক্ষত রয়েছে।

গত মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণের কথা জানান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক। আগুন নেভাতে সকাল থেকে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট। এরপর সেখানে নির্বাপণ কাজে যোগ দেন সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যসহ র‍্যাব, বিজিবি ও ওয়াসার সদস্যরা।