প্রেম-প্রীতি-ভ্রাতৃত্বের অনুশীলন রমজানে

প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

একবার এক অভিজাত বৈঠকে কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর আলাপচারিতা শুনছিলাম নিরাপদ দূরত্বে বসে। সবার বয়স সত্তরের বেশি। বার্ধক্যের নানা সমস্যা নিয়ে আলাপ প্রসঙ্গে একজনের পরামর্শ, এই বয়সে শরীর ঠিক রাখতে হলে হালকা উঠবস করতে হবে, শরীরের একটু কসরত দরকার। বলতে চেয়েছিলাম, শেষ বয়সে হলেও যদি নামাজের প্র্যাক্টিসটা করতেন দেখতেন, কত ভারসাম্যপূর্ণ শারীরিক কসরত হয়ে যাচ্ছে। নামাজের চেয়ে হালকা উঠবস কী কল্পনা করা যায়, যাতে শরীরের সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল ও সক্রিয় হয়।

টিভিতে একজন শরীরচর্চাবিদের আলোচনা শুনেছিলাম। তিনি বুঝিয়ে বলছিলেন, অনেকে তারুণ্যে জিমে যায়, শরীরচর্চা করে, তাতে শরীরের দু-একটি অঙ্গ আন্দোলিত হয়। কিন্তু আমি যখন নামাজ পড়ি, পুরো শরীরের সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত চলাচল হয়। একটি নির্দিষ্ট বয়সে বা সময়ে নয়, যতদিন বেঁচে থাকে একজন নামাজি, আল্লাহর ইবাদত করলে তার শরীরচর্চার কাজটিও হয়ে যাচ্ছে। ভারত থেকে চিকিৎসা শেষে ফিরে একজন অভিজ্ঞতার কথা বললেন। আমার দীর্ঘদিনের ঘাড়ের ব্যথা। ডাক্তার বললেন, ৩০ সেকেন্ডের জন্য ঘাড়টি ডান দিকে ঘুরিয়ে চাপের মধ্যে রাখবেন। তারপর ৩০ সেকেন্ড বামদিকে চেপে ধরবেন। আসলে নামাজে সালাম ফেরানোর সময় মনের অজান্তে যে ঘাড়ের বা সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যয়াম হয়ে যাচ্ছে, তা কী আমরা চিন্তা করে দেখেছি?

মুসলিম সমাজে মসজিদ কত বড় নেয়ামত, শহুরে জীবনে অভ্যস্তরা তা অধিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন। একই মহল্লায় বা একই বিল্ডিংয়ের ভিন্ন ভিন্ন ফ্লোরে বছরের পর বছর জীবন কাটাই, অথচ একে অপরের সঙ্গে দেখা নেই। প্রত্যেকের বসবাস নিজ নিজ দুনিয়ায়। সকালে উঠে তড়িঘড়ি বেরিয়ে যাওয়া, সন্ধ্যায় ফিরে একই কোটরির বাসায়। এ অবস্থায় সর্বস্তরের লোকের মেলামেশা, পরিচয়, অন্তরঙ্গতার সুন্দর পরিবেশ মেলে ধরে মসজিদ। দৈনিক পাঁচবেলা মসজিদে যেতে হাঁটার কদর কতখানি, ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগীদের যুক্তি দিয়ে বুঝানোর প্রয়োজন নেই।

ইসলামের প্রতিটি ইবাদত অনুষ্ঠান নিয়ে চিন্তা করলে দেখতে পাব, একদিকে আছে আপন সৃষ্টিকর্তা ও লালন-পালনকর্তা আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ার তাগাদা। অন্যদিকে মানুষে মানুষে সম্পর্ক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার অতুলনীয় ব্যবস্থা। এ জন্যই একান্তে নিভৃতে আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার মাধ্যম জামাত সহকারে নামাজ, একই সময়ে রোজা পালন ও হজের বিশ্ব সম্মেলনের নানা আয়োজন।

মাহে রমজানের সব আয়োজনের মধ্যেও আল্লাহ ও বান্দার সঙ্গে যুগপৎ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও পরিচর্যার এই বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান। এক সঙ্গে সাহরি, ইফতার, তারাবি ছাড়াও ইতেকাফ, ঈদ উদযাপন, ধনীদের পক্ষ থেকে গরিবদের মাঝে জাকাত, ফিতরা, দান-সদকা ও ঈদ উপহার বিতরণের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য একটি আদর্শ ইসলামি সমাজের চিত্র অঙ্কন করে দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে।

আমরা যখন নামাজ শেষ করি ডান ও বাম দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলি, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আপনাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও দয়া বর্ষিত হোক। একটি আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য এর চেয়ে সুন্দর ব্যবস্থাপনা কি কোনো সমাজতাত্ত্বিক কল্পনা করতে পারেন?

সমাজে সুসম্পর্ক, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার গুরুত্ব ইসলামে এত বেশি যে, কোরআন মজিদে ঘোষণা করা হয়েছে। নিশ্চয়ই মোমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। হাদিস শরিফে এই ভ্রাতৃত্বের পরিচর্যার বিষয়টিকে নানা উপমার সাহায্যে আমাদের বোধের কাছে এনে দিয়েছেন প্রিয় নবীজি।

আবু মুসা আল আশআরি থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মোমিন অন্য মোমিনের জন্য প্রাচীর স্বরূপ। এর এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। (এ কথা বলার সময়) তিনি তাঁর এক হাতের আঙুল অন্য হাতের আঙুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে দেখান।’ (মুসলিম)

ইসলামি বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি আছে অপর হাদিসে।

নোমান ইবনে বশীর (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া-অনুগ্রহ ও মায়া-মমতার দৃষ্টিকোণ থেকে মোমিনরা একটি দেহের তুল্য। যদি দেহের কোনো অংশ অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও তা অনুভব করে। রাত জেগে বা জ¦রে আক্রান্ত হয়ে এই সহমর্মিতা প্রকাশ করে। (অন্য মোমিনের দুঃখ-বেদনার সময় মোমিনের মনের অবস্থাও এরকমই হওয়া চাই)। (মুসলিম)।

সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন অটুট রাখার জন্য ছয়টি অধিকারও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে পরস্পরের ওপর। ১. তুমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সালাম দেবে। ২. সে তোমাকে দাওয়াত দিলে গ্রহণ করবে; ৩. তোমার কাছে উপদেশ (বা পরামর্শ) চাইল উপদেশ দেবে; ৪. হাঁচি দিয়ে সে আলহামদুলিল্লাহ বললে তুমি জবাবে বলবে ইয়ারহামুকাল্লাহ (আল্লাহ তোমাকে রহম করুন); ৫. সে রোগাক্রান্ত হলে তাকে দেখতে যাবে; ৬. আর যদি সে মারা যায় তার জানাজায় (কাফন দাফনে) শরীক হবে। (মুসলিম)।

আশ্চর্য হলো, মোমিনের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সূত্রে আল্লাহর ভালোবাসার বন্ধনে যুক্ত হওয়া যায়।

আবু হুরাইরা (রহ.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন : এক ব্যক্তি অন্য জনপদে বসবাসরত তার এক ভাইকে দেখতে গেল। আল্লাহতায়ালা তার জন্য রাস্তায় একজন ফেরেশতা মোতায়েন করে দিলেন। যখন সে রাস্তায় এলো, ফেরেশতা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা রাখেন। লোকটি বলল, এ লোকালয়ে আমার এক ভাই থাকে, তার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছি। ফেরেশতা বলল, তার কাছে আপনার কী কোনো অর্থিক লেনদেনের ব্যাপার আছে। সে বলল, আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই আমি তাকে ভালোবাসি। অন্য কোনো স্বার্থ নেই। ফেরেশতা বলল, আমি আল্লাহর দূতরূপে আপনার কাছে এ সংবাদ জানানোর জন্য এসেছি যে, আপনি যেমন (আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন, আল্লাহও তদ্রƒপ আপনাকে ভালোবাসেন। (মুসলিম)।

আবু হুরাইরা (রহ.) বর্ণনা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রুগ্ণ ব্যক্তিকে দেখতে যায় অথবা নিজের ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন ঘোষক তাকে ডাক দিয়ে বলে, তুমি আনন্দিত হও, তোমার পথচলা কল্যাণময় হোক এবং জান্নাতে তোমার উচ্চ মর্যাদা হোক। (তিরমিজি)।