ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদ ও পহেলা বৈশাখ ঘিরে চাঙা হয়ে উঠছে জাতীয় অর্থনীতি

গ্রামীণ জীবনে বাড়বে আর্থিক সচ্ছলতা
ঈদ ও পহেলা বৈশাখ ঘিরে চাঙা হয়ে উঠছে জাতীয় অর্থনীতি

করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে দেশে-বিদেশে। এতে জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতির ছোঁয়া লাগছে। এই ঊর্ধ্বগতির ছোঁয়া ও অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠার উপলক্ষ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখকে। কেননা দেশের অর্থনৈতিক দিক থেকেও ঈদুল ফিতরে রেমিট্যান্স প্রবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেইসঙ্গে স্বাভাবিকের চেয়ে এই দুটি উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশীয় শিল্প, কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন ও কেনাবেচা বহুগুণে বেড়ে যায়। ফলে শহর ও গ্রামীণ জীবনে ফিরে আর্থিক সচ্ছলতা। ঈদুল ফিতরের পাশাপাশি বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল পালিত হবে। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মার্কেট, শপিংমল ও ফ্যাশন হাউসে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। উৎসব ঘিরে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবাতাস বইছে। তবে লেনদেন ঠিক কতটা বাড়বে তার সঠিক তথ্য সরকারি খাতায় নেই। তবে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তথ্য-উপাত্তের সমীক্ষা দিয়ে থাকে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা আশা করছেন, এবার ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখে হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি লেনদেন হবে। ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক পরিসর বড় হচ্ছে। করোনার প্রকোপ না থাকায় অনেকেই বাড়তি কেনাকাটা করছেন।

ঈদুল ফিতর মুসলমানদের সবচে বড় ধর্মীয় উৎসব। এ সময়ে পোশাক-পরিচ্ছদ, জুতা ও গৃহসামগ্রীসহ চাহিদার প্রায় সব পণ্যই মানুষ কিনে। প্রতি বছর ঈদকে সামনে রেখে পরিবারের কাছে অর্থ পাঠান প্রবাসীরা। এবার বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্যেও অন্যান্য বছরের মতো ঈদের আগ মুহূর্তেই প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবাহ বেড়েছে। দেখা গেছে- চলতি বছরের মার্চে রেমিট্যান্স দুই বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০১ কোটি ৭৬ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৭ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ২১ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার বেশি। রেমিট্যান্স প্রবাহ ও ঈদের কেনাকাটায় জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশ ফ্যাশন ডিজাইনার অ্যসোসিয়েশনের সভাপতি ও অঞ্জনস শোরুমের স্বতাধিকারী শাহীন আহমেদ বলেন, করোনা মহামারির কারণে দুই বছর ঈদ উপলক্ষ্যে খুব একটা বেচাকেনা করা সম্ভব হয়নি। এবার পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরের উৎসবে ফ্যাশন হাউসগুলোর পরিবেশ খুব ভালো।

ঈদকে ঘিরে পোশাক কেনাকাটা ও পরিবহণ খাতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। রাজধানীর নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, উত্তরাসহ বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা শহরেও ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে উত্তরা নর্থ টাওয়ারের বস্ত্রালয়ের শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক বছর ঈদুল ফিতর সামনে রেখে পরিবারের সদস্যদের জন্য পোশাক কেনাকাটা করতে আসেন মানুষ। তবে কুরবানির ঈদে পোশাক বিক্রি তেমন একটা হয় না। অন্যান্য উৎসবের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পোশাক বিক্রি করা ঈদুল ফিতর সামনে রেখে। ব্যবসায়ীদের কাছে ঈদুল আজহা বোনাসের মতো। বাস, ট্রেন, লঞ্চ, উড়োজাহাজ ও অন্যান্য পরিবহণ মিলিয়ে ঈদ যাত্রায় বিপুল অর্থ লেনদেন হবে।

নিউমার্কেটের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে অর্থনৈতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় এতদিন পোশাক বেচাকেনা কম ছিল, ঈদকে সামনে রেখে বেচাকেনা কয়েকগুণ বেড়েছে। স্বাভাবিক দিনে কমবেশি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার পোশাক বিক্রি করতে পেরেছি, এখন দিনে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার পোশাক বিক্রি হচ্ছে। ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসবে, পোশাক বেচাকেনা ততই বাড়বে। তারা আরও বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় গত বছরের তুলনায় এবার পোশাকের দাম বেশি। সেজন্য বড় বড় শপিংমলের চেয়ে ফুটপাত ও ছোট দোকানে বেশি বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যে যার সাধ্যমতো কেনাকাটা করছে। দেশীয় ব্র্যান্ডের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো।

ঈদকে সামনে রেখে জুতা ও বিভিন্ন ধরনের পোশাকের ডিসকাউন্ডের পাশাপাশি মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও ডিসকাউন্ট দিয়েছে। ক্রেতাদের জন্য সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ ডিসকাউন্টে নির্দিষ্ট মডেলের মোবাইল ফোন বিক্রি হচ্ছে। এতে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বিক্রি বেড়েছে। বসুন্ধরা মার্কেটে মোবাইল ফোন কিনতে আসা সেফালি আক্তার বলেন, জানুয়ারি মাস থেকে ভাবছি স্মার্ট মোবাইল ফোন কিনব। তখন বন্ধুরা বলল- ঈদের আগে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন প্যাকেজে ছাড় পাওয়া যাবে। সেজন্য আজকে মোবাইল ফোন কিনতে বসুন্ধরায় এসেছেন।

সারা দেশে সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী বোনাস পাবেন। এক কোটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরও প্রায় দেড় কোটি কর্মকর্তা-কর্মচারীও বোনাস পাবেন। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের ঈদ বোনাস, বেতন, বিশেষ ভাতা, রেমিট্যান্স সব মিলিয়ে লেনদেনের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। ঈদে বাড়তি চাহিদা থাকায় কোম্পানিগুলোও পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়তি আয়ের আশায় ঈদ মার্কেট ধরতে জমানো অর্থ ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন ব্যবসায়ীরা।

গ্রামের মানুষগুলো জীবিকার তাগিদে চাকরি, ব্যবসা, কিংবা অন্য কোনো কাজের আশায় শহরমুখী হয়। কিন্তু ঈদ আগমনের সাথে সাথে চিত্র বদলে যায়। তারা শহর ছেড়ে শিকড়ের টানে ছুটে নিজ বসতবাড়িতে। ঝিমিয়ে থাকা মফস্বল ও গ্রামের হাট বাজারগুলো দিন কয়েক জন্য প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায়। ফলে গ্রামগঞ্জের হাট বাজারের অর্থনৈতিক লেনদেনে গতি পায়। গ্রাম ও শহরের অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ঈদ উদযাপনে শহর ছেড়ে অনেক মানুষ গ্রামে বেড়াতেও যায়। এতে ঈদের কয়দিন আগে-পরে ট্রেন, বাস, লঞ্চের টিকিট বিক্রির তোড়জোড় চোখে পড়ে। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ দামেও টিকিট বিক্রির খবর শোনা যায়। অতিরিক্ত লেনদেনের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য বাড়ে। অনেক সময় তারল্য সংকটের কারণে কলমানি মার্কেট থেকে চড়া সুদে ধার-কর্জ করে ব্যাংকগুলো।

ঈদে অর্থনীতি চাঙার বিষয়ে সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবরা বোনাস পাচ্ছেন। ঈদে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা ভালো ব্যবসার আশায় থাকেন। পরিবহণ খাতের অর্থনৈতিক প্রভাব ঈদের বাজারে পড়ছে।

তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সংকট থাকার পরও ঈদে অর্থনীতির সব খাতই চাঙা হয়েছে। এবার ব্যবসায়ীরা পুঁজি সংগ্রহ করে তাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। ঈদে যেমন জিনিসপত্র বিক্রয় থেকে আয় বাড়ে, তেমনি জিনিসপত্র ক্রয়েও ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ফলে, জাতীয় অর্থনীতিতে এক ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়।

ঈদ উপলক্ষ্যে অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ, মুদ্রা লেনদেন, আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রসার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধনাত্মক প্রভাব ফেলে।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, ঈদকেন্দ্রিক বেচাবিক্রি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু করোনার কারণে গত তিন বছরে ঈদের অর্থনীতি অস্বস্তি ছিল। তবে এ বছরের প্রেক্ষাপট পুরোপুরি ভিন্ন। এখন করোনা নেই। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদের কেনাকাটা করছেন। এর ফলে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীরা সারাবছর ঈদুল ফিতরের জন্য মুখিয়ে থাকেন। ঈদকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন বিনিয়োগ করছেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, ঈদে সারা দেশের ২৫ লাখ দোকানে কেনাকাটা শুরু হয়েছে। মুদি থেকে শুরু করে এসব দোকানের মধ্যে কাপড়ের দোকান, শোরুম ও ফ্যাশন হাউসগুলোও রয়েছে। এসব দোকানে বছরের অন্য সময় প্রতিদিন ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হলেও রোজার মাসে সেটি তিনগুণ বেড়ে হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। ওই হিসাবে রোজার এক মাসে এই ২৫ লাখ দোকানে ঈদ পোশাক থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হবে প্রায় হাজার কোটি টাকারও বেশি।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ঈদের বেচাকেনা শুরু হয়েছে। করোনার প্রকোপ না থাকায় এবার ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি যথেষ্ট ভালো। এরই মধ্যে পাইকারি বাজারে ভালো বেচাকেনা হয়েছে। আশা করছি, খুচরা পর্যায়ে রেকর্ড বেচাবিক্রি হবে।

খাদ্যপণ্যের মধ্যে সেমাই-চিনি, মাংস, মিষ্টি, গ্রসারি পণ্য রয়েছে। প্রসাধনী, ইলেক্ট্রনিক টিভি, মোবাইলসহ নানা ধরনের পণ্যও কেনা হয় ঈদ উপলক্ষ্যে। অনেকে আবার সোনার গয়না, ঘরের আসবাবপত্র কিনবেন। রোজা ও ঈদে ভোজ্যতেলের চাহিদা হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টন, চিনি সোয়া ২ লাখ টন থেকে পৌন তিন লাখ টন, ডাল ৬০ হাজার টন, ছোলা ৫০ হাজার টন, খেজুর ১৩ হাজার টন, পেঁয়াজ ৩ লাখ ২৫ হাজার থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন এবং রসুনের চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব টাকার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকার জোগান দেয়া হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত