ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে বেচা-বিক্রি শুরুর উদ্যোগ

বঙ্গবাজারের ছাইয়ের মধ্যে স্বপ্ন বুনছেন ব্যবসায়ীরা

বঙ্গবাজারের ছাইয়ের মধ্যে স্বপ্ন বুনছেন ব্যবসায়ীরা

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় বঙ্গবাজারের বঙ্গ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, আদর্শ মার্কেট ও এনেক্সকো টাওয়ার। এতে সর্বস্ব হারিয়েছেন কয়েক হাজার ব্যবসায়ী। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের আশপাশের এলাকায় এখনও পোড়া গন্ধ। স্থুপ স্থুপ ছাই। আগুনে পোড়ার পর দোকানের টিন, লোহা, গ্রিল এবং শার্টার সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, অর্থসহায়তার সঙ্গে দোকান বসার সুযোগ করে দেয়ার। ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, মার্কেটের জায়গা পরিষ্কারের কাজ চলছে, পরিষ্কার হলেই দোকান বসতে পারবে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ছাইয়ের মধ্যেই ‘স্বপ্ন’ বুনছেন, স্বপ্ন খুঁজছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে বেচাবিক্রি শুরু করতে চায় তারা। একই সঙ্গে পুনর্বাসন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। সদ্য পুড়ে যাওয়া রাজধানীর বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান বলেছেন- আমার দোকানের সব পুড়ে গেছে। তারপরও এসেছি। বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না। তিনদিন ধরে এক সেকেন্ডের জন্যও ঘুম আসে না। পোড়া দোকানে ছাইয়ের ওপর বসে থাকতেই ভালো লাগে। সেখান থেকে যেতে মন চায় না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ঈদের জন্য ত্রিশ লাখ টাকার নতুন মাল আমার দোকানে ছিল। এছাড়া আগের ১০ লাখ টাকার মাল ছিল। সব মিলে ৪০ লাখ টাকার মাল ও নগদ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দোকানে ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছুই ভালো লাগছে না। তাই পোড়া দোকানের ওপর এসে বসে আছি। তিনি বলেন, দ্রুত আমাদের পুনর্বাসন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ করেন ওই ব্যবসায়ী।

একই অবস্থা মিরাজ ব্যাপারী নামের আরেক ব্যবসায়ীরও। কত স্বপ্ন ছিল তার এই দোকান নিয়ে। তিনিও নিজের দোকানে ছাইয়ের মধ্যে কিছু একটা খুঁজছেন। কি খুঁজছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কি আর খুঁজব বাবা? আমার সব শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, মহানগর মার্কেটে আমার ‘আল্লাহ দান’ নামের একটি প্যান্ট তৈরির কারখানা ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গতকাল সকালে এসে পোড়া দোকান থেকে একটি সেলাই মেশিনের মাথা খুঁজে পাইছিলাম। পরে সেটা ভাঙারির দোকানে ২৭০০ টাকা বিক্রি করে দিছি। এই টাকা দিয়ে ইফতার ও সেহরি কিনেছি। আজও এসেছি, কিছু একটা পাই কি না।

দোকানে কি কি ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ওই মার্কেটে ৩০ বছর চাকরি করেছি। ৫ বছর ধরে আমি প্যান্ট তৈরির একটি দোকান দিয়েছি। আমার দোকানে ছোট-বড় ১০টা মেশিন ছিল। সব পুড়ে ছাই। দোকানে তিনজন কর্মচারি কাজ করত জানিয়ে মিরাজ ব্যাপারী বলেন, আমার কাছে এখন কোনো টাকা নেই। পুরান ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকি। আমার তিন সন্তান। এখন তাদের নিয়ে কোথায় যাব?

সরকার থেকে অনুদান দেওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাব কি না আমার জানা নেই। তবে দোকান মালিক সমিতির তালিকায় তো আমার নাম আছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী নয়, পুনর্বাসন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে মালিক পক্ষেরও। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত আসন-৫ এর (১৩, ১৯, ২০নং ওয়ার্ড) কাউন্সিল রোকসানা ইসলাম চামেলী। তিনি আংশিক পুড়ে যাওয়া ইসলামিয়া সুপার মার্কেটের মালিক। তিনি বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘটনাস্থলে চলে আসি। আগুন থেকে দোকানের মালামাল রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ কিছু মালামাল বের করেছিলেন। সেই মালামালগুলো রাস্তায় ও ইসলামীয়া সুপার মার্কেটের সামনে রাখা হয়। কিন্তু হঠাৎ করে আগুন লাগা তিন তলা টিনশেড ভবনটি ওই মালামালের ওপর পড়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে ইসলামিয়া সুপার মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ইসলামীয়া মার্কেটে আমাদের ত্রিশটি দোকান পুড়ে গেছে। মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় একটি মসজিদ ছিল। সেটিরও ক্ষতি হয়েছে। আল্লাহর রহমতে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের আমরা আগুন নেভানোর জন্য নিয়ে আসতে পারি। তাই পুরো মার্কেট পুড়ে নাই। রোকসানা ইসলাম চামেলী আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা করবেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি আমাদের মার্কেট দেখতে এসেছিলেন। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলেছেন। এছাড়া আর্থিক সহায়তা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের আশ্বাসও দিয়ে গেছেন। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে বঙ্গবাজারের বর্জ্যগুলো পরিষ্কার করে ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে ব্যবসা শুরু করার আশ্বাসও দিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, অনেক সময় দেখা যায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। এটা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। মার্কেট কমিটিতে যারা আছেন তারা অবশ্যই জানত ওই মার্কেটে কয়টি দোকান ছিল। তারা সঠিক তথ্য তুলে ধরে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। দোকান মালিক, মার্কেট কমিটির সদিচ্ছা থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। তিনি বলেন, নতুন করে তালিকা করার দরকার নেই। নতুন করে তালিকা করলেই অনুপ্রেবেশ করবে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো লাভ হবে না। অপরদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি নাশকতা কি না নিশ্চিত হওয়ার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বোম্ব ডিস্পোজাল টিম ও সিআইডি ক্রাইম সিন টিমের সদস্যরা কাজ করছেন। পোড়া স্তূপ থেকে বেশ কিছু আলামতও সংগ্রহ করেছে সংস্থাগুলো। গতকাল শনিবার এফডিসিতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকা ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন- ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্বের কারণে আগুন কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, বঙ্গবাজারে বহুতল ভবন নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরোধ ছিল। এই দ্বন্দ্বের কারণে আগুন লাগে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আগুন লাগার কারণও ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করছে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের অফিসে হামলায় ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এদিকে গতকাল শনিবার এনেক্সকো টাওয়ারের পশ্চিম পাশে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. নাজমুল হুদা, সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল ইসলামসহ অনেক ব্যবসায়ী।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা এরই মধ্যে পুড়ে যাওয়া দোকানের টিন, লোহা, গ্রিল, শাটারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করেছি। তা থেকে ৪০ লাখ টাকা এসেছে। এ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় খোলা হিসাব নম্বরে দেওয়া হবে। আরও সহায়তা নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে জমা দেবো। যেগুলো পরে মেয়রের মাধ্যমে সরবরাহ করা হবে।

কবে নাগাদ ব্যবসায়ীরা দোকানে বসতে পারবেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে জহিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের এখানে আগুন লাগার পর থেকে পরিষ্কারের কাজ চলছে। শ্রমিকরা দিনরাত কাজ করছেন। এরই মধ্যে শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। তবে আজ কাজ শেষ হলে কালই মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করে দোকান বসানো হবে।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার পুনর্বাসনের দাবিতে বঙ্গবাজারে মানববন্ধন করেছিল আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীরা। ঢাকা রেডিমেড গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, আগুনে তাদের দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন তাদের অন্য কোনো পথ খোলা নেই। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকা রেডিমেড গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, আগুনে পুড়ে আমরা এখন পথে বসেছি। নিরুপায় হয়ে দাবি আদায়ের জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। গত মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ৪৮টি ইউনিট কাজ করেছে। ভয়াবহ এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে এনেক্সকো টাওয়ার ও মহানগর মার্কেটে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত