চট্টগ্রামে ১৫ বছরে পাহাড় ধসে তিন শতাধিক মৃত্যু

* ধস ঠেকাতে বাস্তবায়ন হয় না সুপারিশমালা * শুক্রবারের ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের কমিটি

প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশে গেল ১৫ বছরে পাহাড় ধসে মারা গেছে অন্তত তিন শতাধিক মানুষ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এবার বর্ষা শুরুর তিন মাসের বেশি সময় আগে পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটল। গত শুক্রবার বিকালে আকবর শাহ থানা এলাকায় পাহাড় ধসে একজনের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরো তিনজন। এভাবে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও জোরদার কোন প্রমাসনিক তৎপরতা নেই। পাহাড় ধসে মৃত্যু হলেই পাহাড় কাটা রোধ করতে শুরু হয় তোড়জোড়। কিছুদিন পর আবার আগের মতো সমানে চলে পাহাড় কাটা। সে কারণে হতাহতের ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না। শুক্রবার পাহাড় কেটে দেয়াল তোলার সময় মাটি ধসে পড়লে মজিবুর রহমান ওরফে খোকা নামে একজন নিহত হন, আহত হন আরও তিনজন। হতাহতরা সবাই মিস্ত্রি ও শ্রমিক। নিহত ব্যক্তির বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার খুরুমখালীতে। এদিকে আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। শুক্রবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসানকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অন্য সদসরা হলেন, কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার ভূমি কাট্টলী, সিটি কর্পোরেশন এর মেয়রের প্রতিনিধি, সিডিএ প্রতিনিধি, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, ওসি আকবর শাহ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর প্রতিনিধি।

চট্টগ্রাম নগরীতে ২০০৭ সালের ১১ জুনের ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে অনেকের। ওই দিন চট্টগ্রামের সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছরেও থামেনি পাহাড় ধস। থামেনি মানুষের মৃত্যু। প্রায় প্রতিবছরই কোনও না কোনোভাবে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটেছে। অথচ প্রশাসনের তৎপরতা তেমন নেই।

প্রতি বছর বৃষ্টির আগে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চালায় প্রশাসন। এরপর বাকি সময় সেই তৎপরতা দৃশ্যমান থাকে না। এরপর পাহাড় কাটা শুরু হয়। ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যুর পর একটি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি পাহাড় ধসের ২৮টি কারণ উল্লেখ করেছিল। পাহাড় ধস প্রতিরোধে পাহাড় দস্যুদের চিহ্নিত করা, পাহাড়ে বসতি উচ্ছেদ করে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া ও পাহাড় কাটা বন্ধ করাসহ ৩৬ দফার একটি খসড়া সুপারিশ প্রতিবেদন তৈরি করে। যদিও এর বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। ৩৬ দফা সুপারিশমালার কোন বাস্তবায়ন হয়নি। এ ব্যাপারে একজন পরিবেশবিদ বলেন, ২০০৭ সালে মর্মান্তিক পাহাড় ধসের পর একটি পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। গত ১৫ বছরে এই কমিটি উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই করেনি। ১৫ বছরে ২১টির মতো সভা করেছে। ওইসব সভায় নেয়া কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই।

তার মতে পাহাড় কাটা ও দখলে জড়িতরা চিহ্নিত হওয়ার পর কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত প্রশাসনের। কিন্তু প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর ব্যবস্থা কখনো নেয়নি। এরপর আবার বর্ষা মৌসুম আসে। আবার পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। সেই সঙ্গে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী লোকজন হতাহত হয়। এসব ঘটনা এখন অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা একশ’ বছরেও ঘটেনি। ওই দিন ২৪ ঘণ্টায় ৪২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া অফিস। ওই বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকা, লেডিস ক্লাব, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, শহরের কুসুমবাগ, মতিঝর্ণা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ভোরবেলা অল্প সময়ের মধ্যে এসব পাহাড় ধসে নারী, শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। এরপর গেল ১৫ বছরে পাহাড় ধসে মারা গেছেন আরও অন্তত আড়াইশ’ জন। এর মধ্যে ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়।

২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে দুই জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান তিন জন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়।

২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান চার জন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকা পাহাড় ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। বিচ্ছিন্ন দুই-এক বছর বাদ দিয়ে এভাবে প্রতিবছরই বর্ষায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।

পাহাড় ধসে প্রশাসনের কেন কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা আছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনার পেছনে নানা কারণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে আছে প্রশাসনের উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করা। মূলত প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকার কারণে দরিদ্র, ছিন্নমূল, নদীভাঙা, ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষগুলো নগরীতে এসে কম টাকায় থাকতে পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নেয়। ছোট্ট খুপরিতে গড়ে তোলে সংসার জীবন। আর সেই সব খুপরির ভাড়া তুলে স্থানীয় প্রভাবশালী মাস্তানরা। একারণে পাহাড় ধস এবং মৃত্যু কোনটিই ঠেকানো যাচ্ছে না।

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসন আসলে সব সময় তৎপর ভূমিকা পালন করে। আর প্রশাসনিক এই তৎপরতার সুফল দ্রুত পেতে চাইলে রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু এভাবে আসলে কাজ করা হয়না। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের আগে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি অন্যরাও যদি নিজেদের জায়গা থেকে সঠিক ভূমিকা পালন করে, তবেই কেবল এটি রোধ করা যাবে।

পাহাড়ের পাদদেশে ছিন্নমূল লোকজন অবস্থান করার নানা কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে যদি পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকে তাহলে লোকজন অব্যশই পাহাড়ে থাকতে চাইবে। যাদের পক্ষে বাসা ভাড়া নেওয়া সম্ভব না, তারা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও পাহাড়ে বসবাস করবে। যেসব প্রতিষ্ঠান সার্ভিস লাইনগুলো সরবরাহ করে, তাদের এগুলো বন্ধ করতে হবে। তবে কেউ পাহাড়ের নিচে আর আশ্রয় নেবেনা। প্রাণহানির মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটবেনা।

আকবর শাহ এলাকায় শুক্রবার বিকালে পাহাড় ধসের ঘটনার আগেও প্রশাসনিক তৎপরতা চালানো হয় বলে জানা গেছে। ওই এলাকার বেলতলী ঘোনায় পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে ঠিক দু’মাস মাস আগেও পাহাড় কাটার সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে এক্সক্যাভেটরসহ একজনকে আটক করা হয়েছিল। বেলতলী ঘোনার ফারুক চৌধুরী মাঠ এলাকার ওই জায়গায় শুক্রবার বিকালে সিটি করপোরেশন পরিচালিত একটি প্রকল্পের রিটেইনিং ওয়াল তৈরির কাজের সময় দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পরপর সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী এবং জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ওই এলাকায় পাহাড় কাটার ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ওমর ফারুক সেই অভিযানে মো. শাহজাহান নামে এক ব্যক্তিকে এক্সক্যাভেটরসহ আটক করেছিলেন। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, সিটি করপোরেশনের অধীনে এডিবির অর্থায়নে দুই কোটি ৬৭ লাখ টাকার প্রকল্পের কাজ ছিল এটি। রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ করার সময় এই ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর পেছনে একটা হাউজিং সোসাইটি রয়েছে। সেখানে ভবন করার সময় কাটা মাটিগুলো জড়ো করা হয়েছিল। সেগুলো ধসে পড়েছে। কাজের সময় নিরাপত্তার জন্য যেটা দরকার, সেটা করা হয়নি। কারো গাফেলতি থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাস্থলে কারা কাজ করছিল আমরা খতিয়ে দেখছি। জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হবে। নিহত ব্যক্তির দাফনের জন্য প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকা দেয়া হবে। এছাড়া দুর্ঘটনাস্থলের ঝুঁকি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর একটি ইঞ্জিনিয়ারিং টিমকে ডাকা হয়েছে।