ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রভুহে হালাল রিজিকে বরকত দাও

প্রভুহে হালাল রিজিকে বরকত দাও

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন ‘রমজান মাসে মোমিনের রিজিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।’ রোজাদার সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থেকে কৃচ্ছ্রসাধনা করে। অনেকটা দুনিয়া বিরাগী জীবন চর্চা করে। তারপরও তাদের রিজিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়, কথাটির হাকিকত আমাদের সামনে হয়তো দৃশ্যমান হয় না। তবে একটু গভীরে চিন্তা করলে এর মর্মবাণী আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নিয়ন্ত্রিত আহারই স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়ামক। ডাক্তাররা মেদ-ভুঁড়ি কমানো বা স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য ডায়েট কন্ট্রোলের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। এই ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত ও বিজ্ঞানভিত্তিক মনে হলেও কিছুদিন পর হঠাৎ বন্ধ করলে স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। সেই তুলনায় রোজার মাধ্যমে যে ডায়েট কন্ট্রোল হয়, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। রমজান এক মাস এবং বাকি ১১ মাসে তিন দিন চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের আইয়ামে বীজের রোজার গুরুত্ব স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও অতুলনীয়। কারণ এই ডায়েট কন্ট্রোল হয় ধর্মীয় চেতনায় ও পবিত্র ভাবধারায়।

আমাদের স্বাস্থ্য সমস্যার মূলে আছে মেদ-ভুঁড়ি ও রক্তে চর্বি জমে যাওয়া। এখান থেকেই ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যার মতো জটিল রোগের উৎপত্তি। মেদ-ভুঁড়ি ও রক্তের কোলেস্টেরল জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে শরীর থেকে বের করার পদ্ধতি হলো না খেয়ে থাকা বা নিয়ন্ত্রিত খাবার। রোজার মাধ্যমে এই লক্ষ্যটি অর্জিত হয় ধর্মীয় চেতনায়, পবিত্র ভাবধারায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে রমজানে মোমিনের রিজিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়- হাদিসের এই উক্তির তাৎপর্য আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারব।

দ্বিতীয়ত, শরীরে রক্ত চলাচল অবাধ ও স্বাভাবিক থাকার ওপর যেমন স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নির্ভর করে, তেমনি লেনদেন, বেচাকেনা গতিশীল থাকার ওপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতি। ব্যাংকে টাকা অলস পড়ে থাকা রুগ্ণ অর্থনীতির আলামত। রমজান মাসের কেনাকাটা অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ লক্ষ করলে বলতে হবে, রমজান মাস আমাদের অর্থনীতিতে রক্ত সঞ্চার করে। সমাজের প্রত্যেকেই ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটা করে, ধনীদের পক্ষ থেকে দেয়া জাকাত, ফিতরা ও দান-সদকার টাকা পেয়ে গরিবরাও বাজার সদাই করে। সব মিলিয়ে একটি অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের মহড়া চলে রমজান ও ঈদ উপলক্ষে। এদিক থেকেও রমজানে মোমিনের রিজিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়- কথাটি সত্য ও সঠিক।

মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে আমরা বড় সৌভাগ্যবান যে, ছোটবেলা থেকে হালাল-হারামের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। হালাল-হারাম মেনে চলি। নচেত হিংস্র প্রাণী শিয়াল, কুকুর, শূকর, ভল্লুক, সাপ, ব্যাঙ, কেঁচো সবকিছুই আমাদের খাবার টেবিলে আসত। যেমনটি তথাকথিত সভ্য দেশগুলোর খাবার মেন্যুতে থাকে।

যা খেয়ে হজম হয়, পুষ্টিগুণ আছে ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, সাধারণ বিবেচনায় সে খাদ্য বৈধ। যে খাদ্য খেলে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি আছে, তাকে মনে করা হয় অবৈধ। এটিই দুনিয়ার সাধারণ নিয়ম। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্য হালাল ও বৈধ হওয়ার জন্য শুধু শারীরিক অবস্থার অনুকূল হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং হারাম খাবারে স্বাস্থ্য পরিপুষ্ট হলেও মানুষ নৈতিক দিক থেকে শেষ হয়ে যায়, তাই হারাম।

জন্তু জানোয়ারের গোশত হারাম বা হালাল হওয়ার ব্যাপারেও ইসলাম একই নীতি অনুসরণ করে। শূকরের গোশতে যে জীবাণু থাকে, তা হয়তো রান্নার সময় ধ্বংস করা হয়; কিন্তু এই গোশতের সঙ্গে নাপাকি ও নোংরা চরিত্রের যে প্রভাব মিশে থাকে, তা দূর করার উপায় নেই; যারা খায় তাদের স্বভাবে ও চরিত্রে সংক্রমিত হয়। আল্লাহপাক পরিষ্কার বিধান দিয়েছেন :

‘হে মোমিনরা! আহার কর আমি তোমাদের যে হালাল রিজিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর কর, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদাত কর। তিনি মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশ্ত এবং যা গায়রুল্লার নামে জবেহ করা হয়েছে, তা তোমাদের ওপর হারাম করেছেন। সুতরাং যে বাধ্য হবে, সীমালঙ্ঘনকারী মনোভাব না থাকলে তা খেলে তার কোনো পাপ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা : ১৭২-৭৩)।

কোরআন মজিদের এই নির্দেশনার আলোকে যেসব প্রাণীর গোশত হারাম তন্মধ্যে রয়েছে দাঁত দিয়ে শিকার ধরে ও আহার করে এমন হিংস্র জন্তু : যেমন- বাঘ-সিংহ, নেকড়ে বাঘ, চিতা বাঘ, হাতি, কুকুর, শিয়াল, শূকর, বিড়াল, কুমির, কচ্ছপ, সজারু, বানর ইত্যাদি।

পাঞ্জাধারী হিংস্র পাখি : যেমন- ঈগল, বাজ, শ্যেন, প্যাঁচা ইত্যাদি।

নোংরা ও নাপাক কোনো কিছু : যেমন- মৃত জন্তু, পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ, প্রবাহিত রক্ত এবং সেসব খাবারে কোনো প্রকার উপকার নেই যেমন বিষ, মদ, খড়কুটা, মাদকদ্রব্য, তামাক ও অন্যান্য নেশজাতীয় দ্রব্য।

আল্লাহর নাম উচ্চারণ ছাড়া জবাইকৃত হালাল পশু-পাখিও হারাম। আল্লাহর নামে জবাই করার অর্থ হলো, আল্লাহর সৃষ্ট প্রাণীকে খাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ। এই অনুমতি না নেওয়া মানে আল্লাহর সম্পদে অনধিকার চর্চা করা, যা হারাম।

ছোটবেলা থেকে পারিবারিক পরিমণ্ডলে ইসলামি চরিত্র ও জীবনবোধে লালিত-পালিত হওয়ার কারণে আমরা খাওয়া-দাওয়ায়, এমনকি পাকি-নাপাকি মেনে চলার ক্ষেত্রে অভ্যস্ত। পরিতাপের বিষয় হলো, অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী চিন্তার প্রভাবে অনেকে হারাম হালাল মেনে চলি না। পবিত্র মাহে রমজানের সাধনা যেন আমাদেরকে সর্বক্ষত্রে হারাম-হালাল মেনে চলতে উজ্জীবিত করে। রমজানের এই শিক্ষা বাকি জীবনেও আমরা মেনে চলব, এই সিদ্ধান্ত হোক প্রত্যেকের।

বাংলাদেশে যে ঘনবসতি এবং মানুষের অন্তহীন অভাব-অভিযোগ, তাতে মানুষে মানুষে হানাহানি, চুরি-ডাকাতি অনেক বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের মসজিদ, মাদ্রাসা, ধর্মীয় সভা-সমাবেশের প্রভাবে মানুষের মধ্যে এক ধরনের নৈতিক পরিশুদ্ধি বিরাজমান, যা উন্নত দেশগুলোতে কল্পনাও করা যায় না। রাজনৈতিক বা দলীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস লালন করা না হলে এই দেশ পরম শান্তিময় হতো।

একবার একজন ইরানি কর্মকর্তাকে নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। একটি ঘরোয়া হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে অনেকদূর হেঁটে আবাসিক হোটেলে যাচ্ছিলাম গভীর রাতে। ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, এমন নির্ভয়ে পর্যটন নগরিতে রাতের বেলা চলাচল ইরানেও সম্ভব নয়। কক্সবাজারের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক বন্ধু বলেছিলেন, এখানকার জুমার ইমামদের অলিখিত সিদ্ধান্ত হলো কক্সবাজারকে তারা নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করবেন। সেই হিসেবে তারা জুমার আলোচনা পেশ করেন। পর্যটন নগরীর জননিরাপত্তার রহস্য এটিই।

মাহে রমজানের আধ্যাত্মিক প্রভাবও আমাদের জীবনে ও সমাজে এভাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে, যদিও তা প্রকাশ্যে দৃশ্যমান হয় না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত