ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মোমিনের ইহকাল পরকাল

মোমিনের ইহকাল পরকাল

পরকালে জান্নাত পরম সুখের নিবাস। সব মোমিনের কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা। জান্নাতকে সাজানো হয়েছে সুখের সব সরঞ্জাম দিয়ে। পবিত্র মাহে রমজানে তাই জান্নাত লাভ ও দোজখ থেকে মুক্তি কামনায় বেশি বেশি দোয়া করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রিয় নবীজি। আমরা দীর্ঘ তারাবির নামাজে বিরতির ফাঁকে দোয়া করি, ‘আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউজু বিকা মিনান্নার...।’ ‘হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে জান্নাত প্রার্থনা করছি এবং জাহান্নাম থেকে তোমার কাছে পানাহ চাইছি...।’

জান্নাতে সুখ সম্ভোগের আয়োজন কল্পনাতীত। বলা হয়েছে, সবচেয়ে নিম্নস্তরের একজন জান্নাতিকে যে বাগান দেয়া হবে, তার একটি গাছের ছায়ায় ৭০ বছর ঘোড়া ছুটালেও ছায়ার বাইরে যেতে পারবে না। এমন বর্ণনা শুনে কেউ ভাববে, এগুলো হয়তো কল্পনা বিলাস অথবা অবাস্তব গল্প।

মওলানা রুমি মসনবি শরিফে বিষয়টি নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন।

আমরা দুনিয়াতে আসার আগে মায়ের গর্ভে ছিলাম। কথাটি স্মরণ করতে না পারলেও বাস্তব অভিজ্ঞতায় বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করতে বাধ্য। মাতৃগর্ভে আসার আগে কোথায় ছিলাম? বাবার ঔরসে। তার আগে সৃষ্টিলোকের অনুপরমাণুতে ছড়িয়ে ছিল আমাদের দেহের উপাদান। আমাদের প্রাণের অবস্থান ছিল রুহের জগতে। ধর্মীয় পরিভাষায় আলমে আরওয়াহ।

মাতৃগর্ভে আসার চার মাস পর রুহ সঞ্চারিত হয়। তখন বাইরে থেকে বাচ্চার অস্তিত্ব আঁচ করা যায়। নড়াচড়া করে, মনে হয় বেশ আরামে কাটছে জীবন। এক ফেরেশতা এসে বলেন, হে মানবশিশু। এখানে মাতৃগর্ভ তোমার স্থায়ী নিবাস নয়। মাতৃগর্ভকে তুমি ভাবছ, এটিই একমাত্র দুনিয়া। সুখ-দুঃখ এখানে। এর বাইরে অন্য কোনো জগৎ নেই। তোমার এই ধারণ ভুল। কম-বেশি ৯ মাস পর তোমাকে এই জগৎ ছেড়ে যেতে হবে অন্য জগতে। তার নাম দুনিয়া। সেই দুনিয়া তোমার মাতৃগর্ভের জগতের তুলনায় লক্ষকোটি গুণ বড়। এত বড় যে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। সেখানে গাছপালা আছে। গরু-ছাগল, হাতি, ভল্লুক আছে। আফ্রিকার গহিন বন আছে। আছে সাত সমুদ্র তের নদী। স্থলভাগের চেয়ে তিন-চতুর্থাংশ বড় সাগর-মহাসাগর।

কতশত যুদ্ধাস্ত্র, বিমান-কামান, রণাঙ্গন আরো কত কিছু। সেখানকার একটি গাছের কথা চিন্তা কর, তোমার মায়ের পেটের এই দুনিয়ার তুলনায় হাজার হাজার গুণ বড় তার ডালপালার বিস্তার। মাতৃগর্ভের শিশুর এ কথা বিশ্বাস হয় না। চিন্তা করে, তা কী আদৌ সম্ভব। তাই জন্মের সময় সে কাঁদে। মাতৃগর্ভের জগৎ ছেড়ে আসতে চায় না। তবে জন্মের পর আরেক বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। চোখ মেলে দেখে, এক আজব দুনিয়ায় এসেছি। সত্যিই এখানকার জীবনযাত্রা বিচিত্র। এখানে মা-বাবা আছে। ঘর-সংসার আছে। হাটবাজার মানুষে ভর্তি। এখানকার জমিনের চেয়ে আকাশ আরো বিশাল। যতই দৃষ্টি প্রসারিত করি পৃথিবীর আয়তনের শেষ সীমা জানা নেই। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার বিচিত্র দুনিয়া আগের দুনিয়ার চেয়ে লক্ষ-কোটি গুণ নয়, তার চেয়েও বড়, বিশাল।

এখানে থাকার সময়কাল ৯-১০ মাস নয়। কারো জন্য এক-দুই দিনও নয়। যৌবনের শুরুতে কারো বিদায়। কেউ বার্ধক্যে বিদায়ের অপেক্ষায়। তবে চিরস্থায়ী থাকার অনুমতি কারো জন্য নেই। এই জগৎ ছেড়েও তোমাকে যেতে হবে এমন জগতে, যা বর্তমান জগতের তুলনায় অনেক বিশাল। থাকতে হবে অনন্তকাল। মাতৃগর্ভে থাকতে যেমন তুমি দুনিয়ার জীবনের বিশালতা অনুমান করতে পারনি, এই দুনিয়াতে থাকতেও তুমি পরকালের বিশালতা কল্পনা করতে পারছ না।

মায়ের গর্ভ ছেড়ে দুনিয়ায় আসার সময় এখানকার আত্মীয়স্বজন অপেক্ষার প্রহর গুনেছিল। এই সন্তান সুস্থ হবে নাকি প্রতিবন্ধী হবে। কালো হবে না সুন্দর অবয়ব নিয়ে জন্মাবে। জন্মের সময় কোলে তুলে নেয়ার মতো মৃত্যুর পর তোমার রুহকে বরণ করার জন্য ফেরেশতারা আগমন করবেন।

মাতৃগর্ভ ছেড়ে আসার সময় তুমি কেঁদেছিলে। কারণ, ভেবেছিলে তুমি বুঝি মরে যাচ্ছ। কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর বুঝতে পেরেছ আরেক ধরনের জীবন তুমি লাভ করেছ। এখন আবার ভাবছ, তুমি মৃত্যুবরণ করছ, কবরে যাচ্ছ। তোমার জীবনাবসান হচ্ছে। তাই কিছুতেই দুনিয়া ছেড়ে যেতে চায় না তোমার মন। তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যখন মৃত্যুর পরাপার পার হবে, দেখবে যে, তোমার জন্য ফেরেশতারা অপেক্ষমাণ। এ যেন আকাশে ওড়ে ভিন দেশে গিয়ে বিমানবন্দরে স্বাগতিক দেশের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা।

হজরত বারাআ ইবনে আযেব বর্ণিত এক হাদিসে এই সংবর্ধনার বর্ণনা এসেছে অনেক দীর্ঘ।

তিনি বলেন, আমরা একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে এক আনসারি সাহাবির জানাজায় গেলাম। আমরা তার কবর পর্যন্ত পৌঁছলাম। তখনও তাকে কবরে শোয়ানো হয়নি।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসলেন, আমরাও তাঁর সঙ্গে বসলাম। (এমন আদবের সঙ্গে যে) আমাদের মাথার ওপরে যেন পাখি বসে আছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে একটি লাঠি ছিল। তিনি লাঠির মাথা দিয়ে জমিনে আঘাত করেন।

অতঃপর তিনি ওপরের দিকে মাথা তোলেন এবং বলেন, তোমরা আল্লাহর আজাব থেকে আশ্রয় চাও। এ কথা তিনি ২-৩ বার বললেন, এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

‘কোনো মোমিন বান্দার যখন দুনিয়া ত্যাগ করে আখেরাতে পাড়ি জমানোর (মৃত্যুর) সময় উপস্থিত হয়; তখন আসমান থেকে সাদা চেহারাবিশিষ্ট ফেরেশতারা নিচে নেমে আসেন। তাদের চেহারা সূর্যের মতো আলোকোজ্জ্বল। তাদের সঙ্গে থাকে বেহেশতের কাফন ও আতর। তাঁরা তার (মৃত ব্যক্তির) চোখের সীমানায় এবং মৃত্যুর ফেরেশতা (মৃত ব্যক্তির) মাথার কাছে বসেন।

তিনি (মৃত্যুর ফেরেশতা) বলেন, ‘হে পবিত্র ও নেক আত্মা! তুমি আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে আস।’ তখন আত্মা বেরিয়ে আসে, যেভাবে কলসি থেকে পানির ফোঁটা বেরিয়ে আসে।

তখন ফেরেশতারা আত্মাকে তুলে নেবেন; তাকে বেহেশতের আতরযুক্ত কাফনে রাখবেন; সেই কাফন থেকে পৃথিবীর সর্বোত্তম মেশকের সুঘ্রাণ বের হতে থাকবে। তারপর তারা তাকে নিয়ে ওপরে যাবেন।

তারা যখন কোনো ফেরেশতা দলের কাছ দিয়ে অতিক্রম করবেন, তখন ফেরেশতারা বলবে, এটি একটি উত্তম আত্মা।

বহনকারী ফেরেশতারা বলবেন, ‘এটি অমুকের আত্মা। তারা দুনিয়াতে যে নামে পরিচিত ছিল সে পরিচয় দিতে দিতে এগিয়ে যাবে। তারা দুনিয়ার আসমান পর্যন্ত দরজা খুলে দিতে বলবে। তখন দরজা খুলে দেয়া হবে। তারপর ঘনিষ্ঠ ফেরেশতারা পরবর্তী আসমান পর্যন্ত তাকে বিদায় জানাবেন। সপ্তম আসমান পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে।

অতঃপর আল্লাহতায়ালা আদেশ দেবেন, ‘আমার বান্দার দপ্তর ইল্লিয়্যিনে লিখে রাখে;’ আর ইল্লিয়্যিন হচ্ছে সপ্তম আসমানে মোমিনের আত্মা সংরক্ষণের স্থান। মোমিনের আত্মাকে ফের জমিনে (কবরে) তার দেহে ফেরত পাঠানো হবে। এর পর দু’জন ফেরেশতা এসে তাঁকে (মৃত ব্যক্তিকে) কবরে বসাবেন।

(এ যেন বিদেশি মেহমানের নাম দপ্তরে এন্ট্রি করার পর হোটেলে পৌঁছে দেয়ার মতো ব্যবস্থাপনা।)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত