বঙ্গবাজারে ব্যবসায়ীদের সহায়তা তহবিলে ব্যাপক সাড়া

সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা...

প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচএম ফারুক

ভুপেন হাজারিকার গাওয়া বিখ্যাত জনপ্রিয় গান- মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য/একটু সহানুভূতি কি/মানুষ পেতে পারে না-ও বন্ধু...

কিংবা কামিনী রায়ের বিখ্যাত কবিতা ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/এ জীবন মন সকলি দাও/তার মত সুখ কোথাও কি আছে?/আপনার কথা ভুলিয়া যাও। /পরের কারণে মরণেও সুখ/‘সুখ-সুখ’ করি কেঁদো না আর;/যতই কাঁদিবে যতই ভাবিবে/ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।/আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/আসে নাই কেহ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।

এ কবিতার মূল ভাব প্রকাশের মতো বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে হিজরা সম্প্রদায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-প্রেশার মানুষ। এর মধ্য দিয়ে প্রত্যেকে আমরা পরের তরে কথাটির যথার্থতা ফুটে উঠেছে।

রাজধানীর বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। আইএফআইসি ব্যাংকের ওই সঞ্চয়ী হিসাব নম্বরের (০২০০০৯৪০৬৬০৩১) মাধ্যমে দেশ-বিদেশ থেকে যে কেউ অর্থ সাহায্য পাঠাতে পারবেন বলে ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন। গত শনিবার সকালে বঙ্গবাজারে সংবাদ সম্মেলনে দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন- ওই অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া অর্থ প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে।

এরইমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সব চেয়ে বেশি মন কেড়েছে হিজরা সম্প্রদায়ের উদ্যোগ। তারা ব্যবসায়ীদের ২২ লাখ টাকা দিয়েছেন।

গত রোববার আলেয়া হিজড়া নামে একজন তার হজ পালনের টাকা থেকে ২ লাখ টাকা বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করেন। এরপর বাংলাদেশ হিজড়া উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য এই তহবিলে ২০ লাখ টাকা দেয়া হয়।

বাংলাদেশ হিজড়া উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাশ্মির দিপালী হিজড়া বলেন, ‘গত ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে আমরা তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলেছি। আজকে তাদের এই বিপদের সময় আমরা আমাদের এবারের ঈদের যেসব কেনাকাটা রয়েছে সেই কেনাকাটা না করে আমরা আমাদের এই ব্যবসায়ী ভাইদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। সারা দেশ থেকে ২০ লাখ টাকা আমরা তুলেছি। সেই টাকা আজ তাদের কাছে দিতে এসেছি। তারা বেঁচে থাকলে আমরাও বেঁচে থাকব।’

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ১ কোটি টাকা সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিসিসিআই। বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসীদের খোঁজখবর নিতে এসে সংগঠনটির সভাপতি জসিম উদ্দিন এই ঘোষণা দেন। এ সময় সংগঠনটির অন্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি মনে করি এটার স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত। এজন্য এফবিসিসিআইও আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে রাজি আছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সবাই এসেছে এখানে। এটাই সর্বোত্তম সময় সবাই বসে একটা স্থায়ী সমাধানে উপনীত হওয়া দরকার। এফবিসিসিআই থেকে যত ধরনের সহযোগিতা করা দরকার আমরা করতে রাজি আছি। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের যেসব সংগঠন আছে সবাইকে আমি অনুরোধ করব, যেন তারা সবাই বঙ্গবাজার ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। দেশে সাড়ে ৩ কোটি ব্যবসায়ী আছে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ালে আমার মনে হয় না এই ব্যবসায়ীদের এ সমস্যা বেশিদিন থাকবে। এফবিসিসিআই থেকে আমরা ১ কোটি টাকা দিব।

এছাড়াও ২৬ লাখ টাকা জমা দেয়া হয়েছে কুমিল্লা- ৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের নেতৃত্বে। আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম ১০ লাখ টাকা দেব। কুমিল্লা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদককে অনুরোধ করেছিলাম তোমরাও ১০ লাখ টাকা দাও। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বললাম তুমিও ৫ লাখ টাকা দাও। আমরা ২৫ লাখ টাকা তাৎক্ষণিক ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমাদের প্যানেল মেয়রও ১ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন। আমরা ২৫ লাখ টাকার কথা বললেও ২৬ লাখ টাকা হস্তান্তর করেছি।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান নিজেদের একদিনের বেতন ও ইফতারের খরচ বাবাদ দুই লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেন। ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি বলেন, ‘আমাদের অফিসার্স ও কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য সদর দপ্তরের একদিনের বেতন ও ইফতারের খরচের ২ লাখ টাকা তুলে দিয়েছি। এর একটাই কারণ আমরা যে কাজগুলো করি, এতে অনেক ব্যবসায়ী মনে করেন আমরা তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমরা যে তাদের পাশে আছি এজন্য এটি একটি প্রতীকী অংশগ্রহণ।

উল্লেখ্য, বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য যৌথ স্বাক্ষরে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। আইএফআইসি ব্যাংকের ওই অ্যাকাউন্টের নাম ‘বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সহায়তা তহবিল’। অ্যাকাউন্ট নাম্বর হলো- ০২০০০৯৪০৬৬০৩১। যারা সহায়তা পাঠাতে চান, এই নম্বরে ব্যাংকের মাধ্যমে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে পারবেন।

গত ৪ এপ্রিল সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। সকাল ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ৪১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। এরপর ৪৩টি ইউনিট যাওয়ার খবর জানায় ফায়ার সার্ভিস। পরে ৪৮টি ইউনিটের প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা চেষ্টায় দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ৭ এপ্রিল সকালে আগুন সম্পূর্ণভাবে নির্বাপণের ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস।

আগুনে বঙ্গবাজার এলাকার মোট সাতটি মার্কেট পুড়ে গেছে। এর মধ্যে চারটি পুরোপুরি ও তিনটি আংশিক। মার্কেটগুলো হলো- বঙ্গ ইসলামীয়া মার্কেট, বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স, বঙ্গবাজার মার্কেট, এনেক্সকো টাওয়ার, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, আদর্শ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট।