ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

২০ রমজান মক্কা বিজয়ের বার্ষিকী

২০ রমজান মক্কা বিজয়ের বার্ষিকী

মক্কার কুরাইশদের অত্যাচারে মহানবী (সা.) জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন ছয় বছর আগে। মদিনায় এসেও শান্তিতে থাকতে দেয়নি কুরাইশ শত্রুরা। বদর, ওহুদ, খন্দকের মতো বড় বড় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় মুসলমানদের ওপর। এত কিছুর ভেতরও ছেড়ে আসা জন্মভূমি মক্কার মায়া; বিশেষ করে পবিত্র কাবাঘর জিয়ারতের বাসনা জাগরুক ছিল সারাক্ষণ। একদিন নবীজি (সা.) স্বপ্নে দেখেন সাহাবায়ে কেরামসহ কাবাঘর তাওয়াফ করছেন। তার পর ১৫০০ সঙ্গী সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হলেন অনেকটা সন্তর্পণে। কিন্তু হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছার পর কুরাইশরা মক্কা প্রবেশে প্রবল বাধার সৃষ্টি করে। নবীজি কুরাইশদের বুঝাতে চাইলেন, আমরা নিছক ওমরাহর উদ্দেশ্যে এসেছি। মক্কায় স্থায়ী হব না, মদিনায় ফিরে যাব। কিন্তু কুরাইশরা এ কথা মানতে নারাজ। শুরু হলো কূটনৈতিক দেনদরবার। এক পর্যায়ে হজরত উসমান (রা.)-কে মক্কায় পাঠালেন দূত হিসেবে আলোচনার জন্য। তিনি ফিরে আসতে দেরি হলে খবর ছড়িয়ে পড়ে, কুরাইশরা উসমান (রা.)-কে হত্যা করেছে। এই সংবাদে মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা মহানবী (সা.) এর হাতে হাত রেখে শপথ নেয়- উসমান হত্যার বদলা নেবে। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত জান বাজি রেখে লড়াই করবে। এরই মধ্যে উসমান (রা.) নিরাপদে ফিরে আসেন। উভয় পক্ষে সন্ধির প্রস্তাব গৃহীত হয়। ইতিহাসে তা হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত।

সন্ধির কয়েকটি শর্ত ছিল মুসলমানদের জন্য অবমাননাকর। যেমন- মক্কার কোনো মুসলমান মদিনায় পালিয়ে এলে তাকে কুরাইশদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি মদিনার কেউ মক্কায় পালিয়ে যায় তাকে মুসলমানদের কাছে ফেরত দিতে হবে না। মুসলমানরা এ বছর হুদাইবিয়া থেকে ফিরে যাবে। তবে আগামী বছর ওমরাহ পালনের জন্য আসতে পারবে কোষবদ্ধ তলোয়ার নিয়ে। দূরদর্শী বিচক্ষণতায় মহানবী (সা.) আপাতত পরাজয়মূলক এই চুক্তিতে সই করেন, যদিও হজরত উমর (রা)-সহ অনেক মুসলমান প্রথম দিকে তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। হিজরি ছয় সালে সম্পাদিত এই সন্ধিকে কোরআন মজিদে ফাতহে মুবিন (বিরাট প্রকাশ্য বিজয়) বলে আখ্যায়িত করা হয়।

হুদাইবিয়ার সন্ধির একটি শর্ত ছিল, আরব গোত্রগুলো মুসলমান বা কুরাইশ যে কারো সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে। চুক্তিবদ্ধ কোনো গোত্রের ওপর প্রতিপক্ষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আক্রমণ চালাতে পারবে না। কিন্তু কুরাইশদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বনু বকর গোত্র মুসলমানদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ খোজাআ গোত্রের ওপর হামলা চালায়। তাতে কুরাইশরা বনু বকর গোত্রকে সাহায্য করে এবং খোজাআ গোত্রের ওপর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়। খোজাআ গোত্র মদিনায় এসে মুসলমানদের কাছে সাহায্য চায়। কুরাইশরা বুঝতে পারে, ২১ মাসের মাথায় তারা ১০ বছরের এই চুক্তি ভঙ্গ করেছে। চুক্তি নবায়নের জন্য কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মদিনায় চলে যায়। সেখানে নবীজির কাছে সুপারিশ করার জন্য নানাজনের সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হয়। পরে নিজেই মসজিদে নববিতে দাঁড়িয়ে কয়েকটি কথা বলে। নবীজি তার কথার কোনো জবাব না দেয়ায় নিরাশ হয়ে মক্কায় ফিরে যায়।

নবী করিম (সা.) চরম গোপনীয়তার মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এরই মধ্যে ঘটে এক মহাবিপত্তি। জিবরাইল মারফত জানতে পেরে নবীজি হজরত আলী, যুবাইর ও মিকদাদ (রা.)-কে দ্রুত পাঠিয়ে দেন এক মহিলার সন্ধানে। সে মদিনায় যুদ্ধ প্রস্তুতির তথ্য ফাঁস করে এক চিঠি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশে। অশ্ব দাবড়িয়ে অনেক দূর পর তারা মহিলাকে পেয়ে যান। মহিলা এমন চিঠি বহন করার কথা অস্বীকার করে। চূড়ান্ত দেহ তল্লাশির হুমকি দিলে মহিলা চুলের খোঁপা থেকে চিঠিখানা বের করে দেয়। এই চিঠি মুহাজির সাহাবি হাতেব ইবনে বালতার লেখা। তিনি জানালেন, মক্কায় আটকে পড়া আত্মীয়স্বজনের প্রতি কুরাইশরা যাতে সদয় আচরণ করে তার উদ্দেশে তিনি এমন কাজটি করেছেন। তার অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান। তবুও বদর যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন- এই সুবাদে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।

অষ্টম হিজরির ১০ রমজান ১০ হাজার মুসলিম মুজাহিদ নিয়ে পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতিসহ মহানবী মক্কা অভিযানে বের হন। কুরাইশরা আশঙ্কা করছিল, যে কোনো সময় মুসলামনরা আক্রমণের জন্য আসতে পারে। এরই মধ্যে হজরতের চাচা আব্বাস (রা.) মুসলামন হয়ে মক্কা থেকে ছুটে আসছিলেন মদিনার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে নবীজির সঙ্গে মিলিত হয়ে মক্কা অভিযানে শামিল হন।

এই অভিযানে নবীজি যেসব রণকৌশল প্রয়োগ করেন, যুদ্ধের ইতিহাসে তা ছিল অভিনব। শত্রুর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে বিনাযুদ্ধে মক্কা জয়ে এসব কৌশলের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। মক্কার উপকণ্ঠে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে তিনি নির্দেশ দিলেন, ১০ হাজার সৈন্যের প্রত্যেকে একটি করে চুলা জ¦ালাবে রাতের খাবার তৈরির জন্য। আর শৌচাগারের ব্যবস্থা করবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। কুরাইশ গুপ্তচররা রাতের বেলা এসে দেখে বিশাল প্রান্তরজুড়ে আগুন আর আগুন। রিপোর্ট দেয়, অগণিত সৈন্য নিয়ে মুসলমানরা মক্কা আক্রমণ করতে এসেছে। রিপোর্ট যাচাই করতে দিনের গুপ্তচর এসে দূর থেকে দেখে শৌচাগারের সামনে মুসলমানদের দীর্ঘ লাইন। প্রবল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে কুরাইশদের মাঝে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান এসেছিল রাতের আঁধারে। নবীজির চাচা হজরত আব্বাস তাকে শনাক্ত করে মুসলমানদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য নবীজির কাছে নিয়ে যান। এত দিনের পরম শত্রুকে বাগে পেয়েও কোনো প্রতিশোধ নেননি নবীজি। তদুপরি তাকে বিরাট সম্মান দিয়ে একটি ঘোষণা দিলেন-

‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সে আজ নিরাপদ। যে ব্যক্তি আপন ঘরে দরজা বন্ধ করে অবস্থান করবে সেও নিরাপদ আর যে ব্যক্তি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ।’ মহান রণকুশলীর এই ঘোষণায় মক্কার কুরাইশরা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলার চিন্তা করেনি এবং বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়ের পথ সুগম হয়।

২০ রমজান নবীজি বিশাল বাহিনী নিয়ে বিনা বাধায় যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তিনি ছিলেন বিনীত। এতদিনের শত্রু মক্কার কুরাইশদের জন্য তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। কাবাঘরের ৩৬০টি মূর্তি বাইরে ছুড়ে ফেললেন। কাবাঘর শিরিকমুক্ত হলো। আরবজুড়ে ঘোষিত হলো ইসলামের বিজয় বাণী। আজও পৃথিবীর দিকে দিকে যুদ্ধরত মুসলমানদের মাঝে শোনা যায় তার প্রতিধ্বনি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত