ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

খাদ্যদ্রব্যের দামের সঙ্গে বাড়ছে ভেজাল

খাদ্যদ্রব্যের দামের সঙ্গে বাড়ছে ভেজাল

রাজধানীসহ সারা দেশে প্রসাধনীসামগ্রী থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের ছড়াছড়ি। তবে এসব ভেজাল খাদ্য ও পণ্যের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ আরো কয়েকটি সংস্থা। সংস্থাগুলোর অভিযানে ভেজালকারীদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, জরিমানা এবং লাইসেন্স বাতিল করলেও ভেজালের দৌরাত্ম্য কমছে না।

রাজধানীজুড়ে সংস্থাগুলোর বিভিন্ন অভিযানে গিয়ে দেখা গেছে, যেসব খাদ্যদ্রব্য এবং পণ্যের চাহিদা ও দাম বাড়ে সেগুলো বেশি ভেজাল করছে অসাধু চক্র। সম্প্রতি সয়াবিন ও সরিষার তেলের দাম বাড়লে ভেজাল করতে থাকেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। অভিযানে বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার ভোজ্যতেলে ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশসহ বিভিন্ন অভিযোগে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি বাজারের তিনটি তেলের মিলকে জরিমানা করেছে জেলা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এতে জেলা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ওয়ালিদ বিন হাবিব কপিলমুনিতে এ অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় বিনোদ অয়েলমিলকে ৬০ হাজার টাকা, উৎসব অয়েলমিলকে ৫০ হাজার টাকা ও দত্ত অয়েলমিলকে ১০ হাজার টাকাসহ মোট ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

অসাধু ব্যবসায়ীরা বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে সরিষার তেল তৈরি করছে। মেশানো হচ্ছে পাম তেল, পোড়া মবিল, পশুর চর্বি ও খনিজ তেল। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্রে জানা গেছে, বোতলজাত ভোজ্য তেলেও অস্বাস্থ্যকর পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। চক্রগুলো সাবান, বস্ত্রকলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে খনিজ তেল (হোয়াইট অয়েল), সাবান তৈরির পাম অয়েল ও পশুর চর্বি আমদানি করে তা ভোজ্যতেলে মিশ্রণ করছে। এগুলো বাজারে সয়াবিন, বিনো ও পাম তেল হিসেবে বিক্রি হয়। এসব তেলে তৈরি খাদ্য শরীরের পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকর।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত তারা সারা দেশে ৮ হাজার ৫৬২টি বাজারে অভিযান পরিচালনা করে। এর মধ্যে ১৮ হাজার ৬৫১টি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে অভিযুক্ত করে ১৪ কোটি ৫৭ লাখ ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এই সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ৮৩২টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করে ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ৬০০ টাকা জরিমানা আদায় করে এবং অভিযোগকারীদের বিধি মোতাবেক ১৪ লাখ ৫ হাজারেরও বেশি টাকা প্রদান করেছে। ভোক্তা অধিকারের মতো বিএসটিআইসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভেজালের কারণে অভিযুক্তদের কারাদণ্ড প্রদান ও জরিমানা করছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিষাক্ত পদার্থটি পেটে যাওয়ার ১০-২০ দিনের মাথায় প্রাথমিক উপসর্গ ধরা পড়বে। তলপেটে ব্যথা হওয়া কিংবা প্যারেসস্থেশিয়া দেখা দিতে পারে। তারপর ক্রমে পেশি দুর্বল হবে। এমনকি নিম্নাঙ্গে প্যারালিসিসও হয়ে যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভেজালবিরোধী অভিযানে বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশনগুলোয় জনবলের অভাব রয়েছে। জনবলের অভাবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় তারা ভেজালবিরোধী অভিযান চালাতে পারছে না। সে জন্য বিভিন্ন এলাকায় ভেজালবিরোধী অভিযান চালানোর পরেও ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য কমছে না।

গত রোববার রাজধানীর ডেমরা, কাফরুল ও খিলগাঁও এলাকায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বিএসটিআইয়ের যৌথ অভিযানে লাইসেন্স ছাড়া সয়াবিন, নারিকেল ও সরিষার তেল, মধু, মিক্সড মশলা, আচার, মুড়ি, টক দই, আটা, পাউরুটি, বিস্কুট ও কেক পণ্য বিক্রি করার অপরাধে চার প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া অবৈধভাবে সয়াবিন তেল মোড়কজাত এবং বাজারজাত করার অপরাধে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার আশিয়ান এগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির কোনো ট্রেড লাইসেন্সও নেই। বিএসটিআইয়ের ভুয়া ট্রেড মার্ক ব্যবহার করে তরু, দৃষ্টি, তীন, চেরী নামে সয়াবিন তেল মোড়কজাত করে তারা বাজারজাত করে আসছিল। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন বিএসটিআইয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আমিমুল এহসান, ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান ও সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল এবং সহকারী পরিচালক মো. হাসানুজ্জামান। এই অভিযানের বিষয়ে আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, আমাদের কাছে তথ্য ছিল অবৈধভাবে সয়াবিন ও পামঅয়েল তেল বোতলজাত করছিল প্রতিষ্ঠানটি। এখানে এসে দেখলাম, চারটি নাম দিয়ে তেল বোতলজাত করছে তারা। অপরিচ্ছন্ন-নোংরা পরিবেশে তেল বোতলজাত করা হয়। এসব অপরাধে জরিমানা করা হয়েছে এবং সব কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছি।

ভোজ্যতেল ভেজালের দৌড়ে পিছিয়ে নেই জ্বালানি তেল। অনুমোদিত ডিলার, পেট্রলপাম্পগুলোতে তেলের ভেজাল, ওজনে কম দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধের প্রমাণ পাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। জ্বালানি তেলে ভেজাল দূরীকরণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্র্রতিনিধিরা প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করছে। গত বছরের আগস্টে জ্বালানি তেলে ভেজালরোধে সব ফিলিং স্টেশনে তদারকি বাড়ানোর নির্দেশ দেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

তবে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে অসাধু চক্রের বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এরপরও ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

জানা গেছে, ভেজালবিরোধী অভিযানে বিএসটিআইসহ সরকারের পাঁচটি সংস্থা বিভিন্ন সময়ে বাজার, মার্কেট ও কারখানায় অভিযান চালায়। কিন্তু অভিযানের পরও সার্বিক চিত্রের খুব একটা পরিবর্তন আসছে না। যখনই অভিযানে নামা হচ্ছে, ঠিক তখনই দেখা যায়- অনেক কারখানার লাইসেন্স নেই। আবার যাদের লাইসেন্স আছে, তারা বিএসটিআইয়ের শর্ত মানছে না। তাদের জেল-জরিমানায় দণ্ডিত করা হলেও দণ্ড শেষে আবার ভেজাল পণ্য তৈরি শুরু করে।

বিএসটিআই সূত্রে জানায়, চলতি রমজান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত বিএসটিআই বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে জরিমানা ও মামলা হয়েছে। নিজেদের উদ্যোগে ভেজালের বিরুদ্ধে বছরের পুরো সময়ই সংস্থাটি কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে জনবল সংকটের কারণে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে চাপ বাড়ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সারা দেশে ভোক্তা অধিকারের মাত্র ৯৩ জন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। এরমধ্যে ঢাকায় রয়েছেন ২২ জন। জনবল কম থাকায় ভিন্ন সময়ে অভিযান চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। এরপরও প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে ভোক্তা অধিকারের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের প্রয়োজন হয় না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত