ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আল্লাহর ইবাদত ও মা-বাবার খেদমত

আল্লাহর ইবাদত ও মা-বাবার খেদমত

ঈদ আসে আমাদের কচিকাঁচা ফুলকলিদের মাঝে। নতুন জামা, নতুন জুতো নিয়ে তাদের মাতামাতিতে বড়রা ঈদের আনন্দ পায়। আমাদের বুড়ো মা-বাবা বা মুরব্বিরাও ছোটদের মতোই স্নেহের পরশ চান। ঈদে প্রায় প্রত্যেকে নিজের চেয়ে বড়দের ঈদের সালাম জানায়, বিনিময়ে সালামি পায়। আমাদের সামাজিক জীবনের এই সৌন্দর্য, ছোটদের স্নেহ ও বড়দের শ্রদ্ধা করার এই সংস্কৃতি আমরা পেয়েছি মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের বড়দের শ্রদ্ধা করে না আর ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়।’ নবীজির এই শিক্ষাটি কখন যে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে, আমরা জানিও না। পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশে এখন ওল্ডহোম কালচারের বিস্তার হচ্ছে। শিক্ষিত অভিজাত ঘরের যুবকরা বৃদ্ধ মা-বাবাকে বোঝা মনে করে বৃদ্ধ সদনে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তারা আত্মীয়স্বজনের আদর যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়ে চরম হতাশা ও বেদনায় মৃত্যুর প্রহর গনে। কয়েক বছর আগে একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছিল। তাতে আমাদের তথাকথিত অভিজাত ফ্যামিলির করুণ চিত্র জনসমক্ষে আসে। সরকারের একজন জাঁদরেল মন্ত্রীকে, যিনি কথায় কথায় রাবিশ রাবিশ বলতেন, মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় নেয়ার পর ঢাকায় নিজের তৈরি বিরাট বাড়িতে উঠতে দিচ্ছিল না ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আপন বিবাহিত সন্তান। পরে ক্ষমতায় আছে এমন লোকদের প্রভাব খাটিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত থাকার জন্য বাড়ির একটি কামরা বরাদ্দ পেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।

মা-বাবার প্রতি পশ্চিমা সমাজ ও সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গিই এ অবস্থার জন্য দায়ী। একবার একজন মহিলাকে গাড়িতে সিটে বসার বাড়তি সুবিধা দেয়ার জন্য এক ভদ্রলোক বললেন, মা-বোন সবার আছে। এটি আমাদের জাতীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কথা। কিন্তু উঠতি বয়সের এক তরুণ মুখের ওপর জবাব দিল, বউও তো সবার আছে। পশ্চিমা কালচার খেয়ে রোগাক্রান্ত ছাড়া এমন কথা কেউ উচ্চারণ করতে পারে না।

প্রাচ্যে মনে করা হয়, মা-বাবার পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। ইসলামি শিক্ষার প্রভাব। পশ্চিমের ধ্যান-ধারণা হলো, তারা ফুর্তি করেছে, আমরা এসেছি। এখন আমরা ফুর্তি করব। মায়ের পরিচয় আছে বাবার পরিচয় আবার কী। প্রিন্সিপাল এ এ রেজাউল করিম চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের প্রেথিতযশা মনীষী। ইংরেজি ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিল ঈর্ষণীয়। যেসব মহান মানুষের সাহচর্যে আমার জীবন ধন্য ও ঋদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম চৌধুরী প্রধানতম। একদিন একান্ত আলাপচারিতায় বলছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর পেয়ে পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম লন্ডনে। কিন্তু পিএইচডি না করে দেশে ফেরত আসতে হয়েছিল একটি অপরাধে। অসতর্কতায় একদিন ক্লাসে জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, আপনার ফাদার কী করেন। এটুকুন অপরাধই যথেষ্ট ছিল। আমাকে দেশে ফেরত আসতে হয়েছিল। কারণ, সে দেশে সন্তানের বাপের পরিচয় মায়েরাও ঠিক বলতে পারে না। তাই মায়ের নামই লেখা হয় পরিচয়পত্রে। এ অবস্থায় বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগলেও তা প্রকাশ করার জায়গা কোথায়।

বাবার পরিচয়ের দৈন্যতা ঘুচানোর জন্য তারা ঘটা করে বাবা দিবস পালন করে। সেই তুলনায় অনেকগুলো নাইয়ের মধ্যেও আমাদের পারিবারিক জীবনে ছেলেমেয়ে, বউ-ঝি, নাতি-নাতনি, আত্মীয়-প্রতিবেশী বেষ্টিত হয়ে যে শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করছে, তাকে বেহেশতি পরিবেশ বললে অত্যুক্তি হবে না।

নিঃসন্দেহে এই পরিবেশের জন্য আমরা ইসলামের কাছে ঋণী। পবিত্র মাহে রমজানের সাধনা ও ঈদের আয়োজন আমাদের এই ঋণের কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, ‘পিতামাতার পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ এ ক্ষেত্রে কোরআন মজিদের শিক্ষা আরও হৃদয়গ্রাহী। বলা হয়েছে : আল্লাহর ইবাদতের পরই মা-বাবার খেদমতের স্থান। এরশাদ হচ্ছে : তোমাদের পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উফ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না এবং তাদের সাথে ভদ্র বিনম্রভাবে কথা বল।

তাদের সামনে ভালোবাসার সঙ্গে বিনয়ের ডানা বিছিয়ে দাও এবং বল : হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যে রকম দয়ামায়া দিয়ে শৈশবে আমাকে তারা লালন পালন করেছেন। (শুধু এই বাহ্যিক সম্মান প্রদর্শনকেই যথেষ্ট মনে করো না। অন্তরেও তাদের প্রতি আদব ও আনুগত্যের ইচ্ছা পোষণ করবে। কেননা) তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনের কথা খুব জানেন। (এ কারণেই এ বাস্তবায়ন সহজ করার জন্য একটি হাল্কা আদেশও শুনাচ্ছেন যে) যদি তোমরা প্রকৃতই (আন্তরিকভাবে) সৎ হও, (এবং ভুলক্রমে, মেজাজের সংকীর্ণতাহেতু কিংবা বিরক্তিবশত কোনো বাহ্যিক ত্রুটি হয়ে যায়, অতঃপর অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে নাও) তবে তওবাকারীদের অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন। (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৫)।

ইমাম কুরতুবী বলেন, এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা পিতা-মাতার আদব, সম্মান এবং তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করাকে নিজের ইবাদতের সঙ্গে একত্র করে ফরজ করেছেন। যেমন সুরা লোকমানে নিজের শোকরের (কৃতজ্ঞতা) সঙ্গে পিতামাতার শোকর একত্র করে অপরিহার্য করেছেন। বলা হয়েছে : আমার শোকর কর (আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর) এবং পিতামাতারও। (সুরা লোকমান : ১৪)।

এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল, আল্লাহর কাছে কোন কাজটি সবচেয়ে প্রিয়। তিনি বললেন, সময় হলে নামাজ পড়া। সে আবার প্রশ্ন করল, এরপর কোন কাজটি সর্বাধিক প্রিয়? তিনি বললেন, পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার। (বোখারির বরাতে কুরতুবী)।

মুসনদে আহমদ তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুস্তাদরাক হাকেমে আবুদ দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, পিতামাতা জান্নাতের দরজা। এখন তোমার ইচ্ছা, এর হেফাজত কর অথবা একে বিনষ্ট করে দাও। নবীজি বলেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত। (তিরমিজি, মুস্তাদরাক)।

এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞেস করল : সন্তানের ওপর পিতামাতার কী হক রয়েছে? তিনি বললেন, তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম। উদ্দেশ্য এই যে, তাদের আনুগত্য ও সেবাযত্ন জান্নাতে নিয়ে যায় এবং তাদের সঙ্গে বেয়াদবি ও তাদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়। (ইবনে মাজাহ)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যে সেবাযত্নকারী পুত্র পিতামাতার দিকে দয়া ও ভালোবাসা সহকারে দৃষ্টিপাত করে, তার প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে সে একটি মকবুল হজের সওয়াব পায়। লোকেরা আরজ করল। সে যদি দিনে একশবার এভাবে দৃষ্টিপাত করে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, একশবার দৃষ্টিপাত করলেও প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে এই সওয়াব পেতে থাকবে। (বয়হাকি)।

সুবহানাল্লাহ, তার ভান্ডারে কোনো অভাব নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত