ময়মনসিংহে ভ্যাট নিয়ে ধোঁয়াশা

রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ময়মনসিংহ ব্যুরো

ময়মনসিংহে ভ্যাট কর্মকর্তাদের কারসাজির কারণে সচ্ছতা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে জনমনে। যে কারণে হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় আসছে না। এতে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হলেও গোপনপন্থায় পকেট ভারি করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এমন অভিযোগ একাধিক সূত্রের।

জানা যায়, ময়মনসিংহ নগরীতে ভ্যাট আদায়যোগ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় অর্ধ লক্ষ। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠানও ভ্যাটের আওতায় নেই। তবে ভ্যাটের জালে বন্দি না হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভ্যাট কর্মকর্তাদের গোপন রফাদফা রয়েছে বলে জানান নগরীর মাসকান্দা এলাকার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মো. হারুন মিয়া।

সেই সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব মূশক বই বা রেজিস্টার খাতায় লিপিবদ্ধ থাকার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভ্যাট কর্মকর্তাদের দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক তদারকির কথা থাকলেও বাস্তবে এ ধরনের তদারকি চোখে পড়েনি বলে জানান নগরীর গাঙ্গিনাপাড় এলাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দা মো. আলমগীর হোসেনসহ আরও অনেকেই।

অভিযোগ উঠেছে, ময়মনসিংহে ভ্যাট কর্মকর্তারা ব্যবসায়িদের ডেকে এনে গোপন বৈঠকে ভ্যাট আইনের কঠোরতার গল্প শুনিয়ে করা হয় মাসিক রফাদফা। অপরদিকে নিবন্ধিত ব্যবসায়ীরাও ক্রেতাদের কাছ থেকে কড়ায়গন্ডায় ভ্যাট আদায় করলেও সেই ভ্যাট সঠিক পরিমাণে সরকারের রাজস্ব ভান্ডারে জমা হচ্ছে কি না এ নিয়ে রয়েছে সন্দেহ।

একই অবস্থা ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর এলাকায় গড়ে উঠা অসংখ্য ইটভাটা, কলকারখানা, বেকারি এবং কোচিং সেন্টারসহ নানা উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানের। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট আদায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে দাবি করেন নগরীর নতুন বাজার এলাকার কোচিং কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন।

তিনি বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দিলেও অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট কর্মকর্তার সাথে রফাদফা করে নামকাওয়াস্তে ভ্যাট দেয়। ফলে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে মামলা বা হয়রানির কোনো ভয় থাকে না বলেও জানায় এই কোচিং কর্মকর্তা।

ফলে ময়মনসিংহে ভ্যাট আদায়যোগ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, কোচিং সেন্টারসহ বিশাল সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে শতভাগ ভ্যাট আদায় হচ্ছে না। এতে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। গভীর নজদারি করলে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলবে বলেও দাবি নির্ভরযোগ্য সূত্রের।

সূত্রমতে, এসব কারণে ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়িক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে সরকার। এর মধ্যে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) এবং ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন চালু করা হলেও ময়মনসিংহে কোন প্রতিষ্ঠানেই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে না। অথচ ২০০৮ সালে ১১টি খাতে ইসিআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছিল সরকার। সেই সঙ্গে ভ্যাটযোগ্য কোনো পণ্য বিক্রি বা সেবা প্রদান করতে হলে প্রতিটি বিক্রির সমর্থনে ভ্যাট চালানপত্র ইস্যু করা বাধ্যতামুলক থাকলেও তাও ব্যবহার হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ক্রেতা মোহাম্মদ আলীসহ আরও অনেকেই।

ময়মনসিংহ নগরীর বিলাসবহুল নামিদামি ব্যান্ডের শো-রুম গুলোতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা ভ্যাট ফাঁকির ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করেছেন ক্রেতা সাদ উদ্দিন, ফরহাদ হোসেন ও রুবেল মিয়া। এর মধ্যে রিচম্যান, লুবনান, ফপস, র্স্পাক গিয়ার, সেইলর উল্লেখযোগ্য বলেও জানায় তারা।

এই প্রসঙ্গে তারা বলেন, রিচম্যান, স্পার্কগিয়ারসহ এসব শোরুম থেকে থেকে কাপড় কিনলে বিক্রয় রশিদে নির্ধারিত ভ্যাট কেটে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই ভ্যাট কোথায় জমা হচ্ছে বিষয়টি স্পষ্ট না। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ভাবে এই ভ্যাট সংশ্লিষ্ট সার্ভারে জমা হচ্ছে বলে জানায় প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ক্রেতাদের কাছে থেকে ভ্যাট কড়াগন্ডায় কেটে নেওয়া হলেও দিনশেষে তা কোথায় যায় বিষয়টি অজানা। ফলে হিসাব নয়ছয়ে ভ্যাটের কোটি কোটি টাকা।

এই প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ থেকে সদ্য বদলি হওয়া রাজস্ব কর্মকর্তা মো: সাজেদুল ইসলাম ও মোখলেছুর রহমান বলেন, এ ধরনের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কেন্দ্রীয় ভাবে আউটলেটগুলো থেকে ভ্যাট আদায়ে অনেক ঝামেলা হয়। আর এ কারণেই আমরা আউটলেটগুলোতে কেন্দ্রীয় নিবন্ধনে ভ্যাট আদায় বিষয়ে নিরোৎসাহিত করার পরামর্শ দিচ্ছি। সেই সঙ্গে ময়মনসিংহ নগরীর নবাবী রেস্টুরেন্ট ও বেশ কিছু নামিদামি মিষ্টি দোকানগুলোতে দৈনিক লাখ লাখ টাকা বিক্রি হলেও কর্মকর্তাদের সাথে গোপন আতাঁতে নামকাওয়াস্থে ভ্যাট মাসিক হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য কর্মকর্তাদের প্রতি মাসে আলাদা করে টাকা দিতে হয় বলেও জানান সংশ্লিষ্ট কর্মচারিরা। এসব বিষয়ে কথা হলে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট ময়মনসিংহের উপ-কমিশনার মির্জা রাফেজা সুলতানা জানান, ময়মনসিংহ অঞ্চলে মাত্র ছয় হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় রয়েছে। এর মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মাসিক লেনদেনের চালান দেখে ভ্যাট আদায় করা হয়। তবে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মাস শেষে নির্দ্দিষ্ট পরিমান ভ্যাট আদায় করা হয়। প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভ্যাট আদায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলেও ময়মনসিংহের জন্য ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। বরাদ্ধ আসলে তা ব্যবহার করা হবে।