ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কাফেরের পরকালীন যাত্রা

কাফেরের পরকালীন যাত্রা

মাতৃগর্ভ শিশুর জন্য আলাদা এক জগৎ। সে জগৎ ছেড়ে আসতে না চাইলেও নয়-দশ মাসের মাথায় ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে জন্মের পারাপার পার হয়ে আসতে বাধ্য হয় মাটির পৃথিবীতে, নতুন জগতে। এ সময় নিকটাত্মীয় মহিলারা প্রসূতি মায়ের কাছে অপেক্ষায় থাকে ভিন গ্রহের প্রাণীকে পৃথিবীতে বরণ করার জন্য। ফুটফুটে ছেলে সন্তান হলে কোলে তুলে নিতে, আদর মেখে দিতে কাড়াকাড়ি করে আত্মীয়রা।

কিন্তু যদি নবজাতক হয় কিম্ভূতকিমাকার। দেখা গেল মানব সন্তান নয়; একটি অদ্ভুত জানোয়ারের বাচ্চা জন্ম হয়েছে। মাথা অচেনা জন্তুর। সারা শরীর লোমশ। হাত একটা নাই, পাগুলো বাঁকা, তখন প্রসূতির ঘরে অপেক্ষমাণ মহিলাদের মনের অবস্থা কেমন হবে অনুমান করা যায়।

মাতৃগর্ভ থেকে মাটির পৃথিবীতে আসার মতোই, মাটির এই পৃথিবীতে থাকার ভিসার মেয়াদ যখন শেষ হয়ে যায়, মৃত্যু নামক বিমানে চড়ে ফিরে যেতে হয় আসল ঠিকানায়। প্রসূতি ঘরে নিকটাত্মীয় মহিলাদের অপেক্ষার মতো তখন ফেরেশতারা অপেক্ষায় থাকেন মৃত্যুর বিছানায়। দুনিয়াতে সুন্দর চিন্তা, বিশ্বাস ও কর্মের মাধ্যমে যে সুন্দর জীবন গঠন করেছে তার রুহের অবয়ব হয় নিষ্পাপ শিশুর মতো। তাকে সুবাসিত আতর মাখা কাপড়ে জড়িয়ে ঊর্ধ্বজগতে ইল্লিয়্যিনে নিয়ে যেতে ফেরেশতাদের মাঝে কাড়াকাড়ি অবস্থা হয়।

দুনিয়ার জীবনে পাপ-পঙ্কিলতায় যাদের জীবন কলুষিত ছিল, হারাম-হালাল তফাত করেনি, আল্লাহকে মানেনি। রাসুল (সা.) এর সঙ্গে পরিচয় ছিল না; জন্তু-জানোয়ারের মতো শুধু ভোগের রাজ্যে ডুবে রয়েছিল, আসল ঠিকানা আখেরাতে ফিরে যেতে হবে এই বিশ্বাস ও সতর্কতা যাদের জীবনকে স্পর্শ করেনি, কোরআনের ভাষায় যাদের অবস্থা পশুর চেয়েও অধম, দুনিয়া থেকে বিদায়ের সময় তাদের আত্মার অবস্থা হবে কিম্ভূতকিমাকার। অচেনা জানোয়ারের মতো মাথা, হাত পা বাঁকা পঙ্গু বিকলাঙ্গ। তখন ফেরেশতাদের মহলে তাকে কীভাবে ঘৃণা করা হবে তার বিবরণ আছে হাদিস শরিফে।

এক দীর্ঘ হাদিসে মোমিনের আত্মা ঊর্ধ্বগামী হওয়ার বর্ণনার পর নবীজি (সা.) কাফেরদের মৃত্যুকালীন অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, যখন কোনো কাফের দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে আখেরাত পানে যাত্রা করে, তখন তার কাছে কালো চেহারার ফেরেশতারা আগমন করে। তাদের সঙ্গে থাকে চুল দ্বারা তৈরি কষ্টদায়ক কাপড়। তারা চোখ বুজে যাওয়া পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকে। এর পর আসে মৃত্যুর ফেরেশতা। তার মাথার কাছে বসে তিনি বলেন, হে পাপিষ্ঠ আত্মা, বের হয়ে আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের দিকে চলো। তখন তার দেহে প্রচণ্ড কম্পন শুরু হয়। তার আত্মা টেনে বের করা হয়, যেমন ভেজা রেশমের ভেতর থেকে লোহার ব্রাশ বের করা হয়। আত্মা বের করার সময় তার রগ ও স্নায়ুতন্ত্রীগুলো কেটে ছিঁড়ে যায়। আসমান ও জমিনের প্রতিটি ফেরেশতা তার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে। আসমানের দরজাগুলো তার জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রত্যেক দরজার দায়িত্বরত ফেরেশতা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতে থাকে এই পাপিষ্ঠের রুহ যেন তাদের সম্মুখ দিয়ে না যায়। এই পরিবেশে ফেরেশতা তার রুহকে গ্রহণ করে। এরপর ফেরেশতা এক মুহূর্তের জন্যও তাকে ছেড়ে দেয় না। কষ্টদায়ক কাপড় দিয়ে তাকে পেঁচিয়ে ধরে। আত্মা নিয়ে ফেরেশতা রওনা হয়। লাশ পৃথিবীতে পড়ে থাকে।

ফেরেশতা তার আত্মা নিয়ে যখন ওপরে উঠে তখন ঘাটে ঘাটে ফেরেশতারা বলতে থাকে কে এই পাপিষ্ঠ আত্মা? জবাবে তার নাম উল্লেখ করে বলা হয় অমুক, অমুকের ছেলে। দুনিয়াতে যত নিকৃষ্ট নামে তাকে ডাকা হতো, তা উল্লেখ করে তার পরিচয় দেয়া হয়। প্রথম আসমানে গিয়ে তার জন্য দরজা খোলার অনুরোধ করা হলে দরজা খোলা হয় না। এতটুকু বর্ণনার পর নবীজি কোরআন মজিদের এ আয়াতখানি তেলাওয়াত করেন।

‘যারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার এবং সে সন্বন্ধে অহংকার করে, তাদের জন্য আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হবে না। এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সুচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে।’ (সুরা আরাফ : ৪০)।

অতঃপর আল্লাহতায়ালা বলবেন, তার আমলনামা সিজ্জিনে লিখে দাও, যা পৃথিবীর সর্বনিম্ন স্তর। তারপর তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দাও যেখান থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেখান থেকে পুনরুত্থিত করা হবে। এর পর তার আত্মাকে পৃথিবীতে তার দেহে সজোরে নিক্ষেপ করা হবে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) এ আয়াতখানি তেলাওয়াত করেন-

‘আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে এবং তার কোনো শরিক না করে; এবং যে কেউ আল্লাহর শরিক করে সে যেন আকাশ থেকে পড়ে গেল। অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল; কিংবা বায়ু তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।’ (সুরা হজ : ৩১)।

এভাবে তার দেহে তার আত্মা ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ সময় তাকে ছেড়ে যে লোকেরা চলে যাচ্ছে তাদের পায়ের জুতার আওয়াজও সে শুনতে পাবে। এর পর দু’জন ফেরেশতা আসবে। তাকে বসাবে। এরপর তাকে প্রশ্ন করা হবে, তোমার রব কে? জবাবে সে বলবে, হায়! হায়! আমি জানি না। তোমার ধর্ম কী? জবাবে সে বলবে, হায়! হায়! আমি জানি না। ফেরেশতাদ্বয় বলবেন, এ ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের মধ্যে পাঠানো হয়েছিল? তারা তার নাম ঠিক করতে পারবে না। তখন ফেরেশতারা বলবেন, মুহাম্মদ। তখন সে বলবে, হায়! হায়! আমি জানি না। লোকেরা এমন কথা বলাবলি করতে শুনেছি, তবে আমি জানি না। ফেরেশতারা বলবেন, তুমি গন্ডমূর্খই ছিলে। তখন আসমান থেকে এক আহ্বানকারী বলবেন, সে মিথ্যা বলেছে। তাকে জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও। জাহান্নামের একটি দরজা তার জন্য খুলে দাও।

এর পর থেকে জাহান্নামের তাপ ও বিষাক্ততা তার কাছে আসতে থাকবে। তার জন্য কবরকে এমন সংকুচিত করে দেওয়া হবে, যাতে তার হাড্ডিগুলো আলাদা হয়ে যাবে। তার কাছে এক ব্যক্তি আসবে, যার চেহার বিদঘুটে, পোশাক নিকৃষ্ট ও দুর্গন্ধময়। সে তাকে বলবে, যে দিনের খারাপ পরিণতি সম্পর্কে তোমাকে বলা হয়েছিল তা আজ উপভোগ করো। সে এই বিদঘুটে চেহারার লোকটিকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে বলবে, আমি তোমার অসৎকর্ম। এর পর সে বলবে, ‘হে রব, আপনি যেন কেয়ামত সংঘটিত না করেন।’ (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, মুস্তাদরাকে হাকেম)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত