বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় কৃষক এখন পান্তা খায় না

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শাহিনুর রহমান

পহেলা বৈশাখ উদযাপনে সকালের আয়োজনে থাকে পান্তা ভাত খাওয়ার উৎসব। কখন কারা কেন পান্তাভাত খাওয়ার প্রচলন করলেন, সেটা অনেকটাই অজানা। তবে নগর জীবনে পহেলা বৈশাখের সকাল বেলা পান্তা ভাতের সাথে কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ কিংবা ইলিশ মাছের একটি টুকরা থাকলে তো আর কোনো কথাই নেই। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে মানুষ কোনো না কোনো পার্ক বা উদ্যানে বসে পান্তা ভাত খায়। আর এই পান্তা বিক্রি করার জন্য এখন নানা সংগঠন দাঁড়িয়ে গেছে। তারা তাদের সংগঠনের সদস্যদের কাছে পান্তা ভাত বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়ে থাকেন। মাটির সানকিতে একদিনের সকালে পান্তা ভাত খাওয়ার মধ্যে বাঙালিপনার স্বাদ খোঁজার চেষ্টা করা হয়। আসলে নগর জীবনে পান্তাতো নয়, এ যেন গরম ভাত পানি দিয়ে খাওয়া।

পান্তা গরিবের খাবার এবং পান্তা-বাসি খাবার খেতে চিকিৎসকরা নিরুৎসাহিত করে থাকেন। এরপরও নগরবাসী অন্তত পহেলা বৈশাখে পান্তা ভাতের স্বাদ গ্রহণ করেন। এটা কেন তারা খায়, তা হয়তো তারা নিজেরাই ভালো করে জানে না। অতীতে অনেকে খেয়েছে, তাই তাদের খেতে হবে। পরিবার পরিজন নিয়ে পান্তা খাওয়ার মধ্যে যেন একটা আভিজাত ভাব ফুঠে উঠে। তবে এটা ঠিক, সে দিন বেশি দূরে নয়, যখন গ্রামীণ জীবনে সকালে পান্তা খাওয়ার প্রচলনটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। প্রত্যাহিক কাজ-কর্মে গতি আনার জন্য কৃষক পান্তা ভাত খেতেন। সকালের ঘুম থেকে উঠে ঠান্ডা আবহাওয়ায় মাঠে কাজ করা ছিল অনেকটা প্রশান্তির। কেন না, দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের উত্তাপ বাড়তে থাকে। তাই প্রচন্ত গরমে কৃষক সকালের সময়টিকে কাজের মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বেছে নিত। একসময় কৃষিই ছিল আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান চালিকাশক্তি। কৃষিকাজ করে মানুষ জীবিকা নির্র্বাহ করত। যার যত বেশি জমি ছিল, তার তত বেশি ছিল ব্যস্ততা। যার চাষের জমি থাকত না, তারও ব্যস্ততা কম ছিল না। কেন না, অন্যের জমিতে কাজ করে কীভাবে অধিক পয়সা আয় করা যায় সেটাই ছিল তাদের লক্ষ্য। দিনমজুরি করার আগে কিংবা পরে অন্যের জমিতে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে দিয়ে বাড়তি পয়সা ঘরে আনার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠত কৃষক। সন্ধ্যা পর্যন্ত জমিতে কাজ করে পরিষ্কার-পরিছন্ন হয়ে আলাপচারিতার মধ্যে রাতের খাবার রান্না হতো। গরম গরম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস ছিল পরিশ্রমী মানুষের। চৈত্র মাসের ফসল ঘরে তুলতে গিয়ে কৃষক পরিবারের নারী সদস্যদের ব্যস্ততাও ছিল অনেক বেশি। সময় সাশ্রয় করতে কৃষক পরিবারে সকালের রান্না করা সময় সুযোগ না থাকায় অনেক কৃষক পরিবার রাতে একবারে ভাত রান্না করে রাখত। সকালে ওই ভাত কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে খেয়ে সূর্র্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষক জমিতে কাজ করতে যেতেন। পরে সুযোগ সুবিধামতো বাড়ি থেকে সকালের খাবার পাঠানো হতো। সেটা হত রুটি ভাজি কিংবা ঝাও ভাত সঙ্গে গুড় কিংবা কলা। অথবা কোনো একটা ভর্র্তা। দুপুর হলে বাড়ি ফিরে কৃষক গোছল করে ভাত খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার ছুটে যেত ফসলের জমিতে। সারা দিনের ব্যস্ততার কারণে মানুষ খাওয়ার সময় পেত না। রাতে পেটপুরে খেয়ে রাতে প্রশান্তিুর ঘুম ঘুমিয়ে কাক ডাকা ভোরে উঠে আবার ফসলের মাঠে যাওয়া ছিল কৃষকের নেশার মতো। কৃষক পরিবারে নারী সদস্যরাও ফসল ঘরে তোলার ব্যস্ততায় সকালের নাস্তা রান্না করার সময় পেত না। তাই আগের রাতে বেশি করে ভাত রান্না করা হতো। কৃষি অর্থনৈতিক জীবনে সকালে পান্তা ভাত খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আর সেই ধারাবাহিকতায় শহরের মানুষও অন্যদিন না হলেও অন্তত পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তা ভাত খায়। পহেলা বৈশাখে কেন পান্তাভাত খাওয়া হয়, তার কোনো প্রকৃষ্ট কারণ নেই। অনেকের মতে, বাংলার কৃষকের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য হয়তো পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তা খাওয়ার প্রচলন সমাজে গড়ে উঠেছে। এটা যদি কৃষকের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার নামে তাদের অবহেলা কিংবা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয় কিংবা কৃষককে অসম্মানিত করা হয় তাহলে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কেন না, বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছেন ‘আমার কৃষক দুর্নীতি করে না, তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলবেন’। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় ভালো থাকলে কৃষরাই আছে। নগর জীবনে অন্যের অধীনে কাজ করে অর্থ আয় করার চেয়ে স্বাধীন মতো জীবনযাপনের মতো সুখ আর নেই। আমাদের কৃষক এখন সকালে পান্তা খায় না। একদিনের আয় দিয়ে সে পরিবার পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন পার করতে পারে। এক বেলা শ্রম বিক্রি করে অপর বেলা নিজের জমি-জমায় কাজ করে কিংবা শাকসবজি চাষাবাদ করে সহজেই খাদ্যের জোগান দিতে পারে। গোয়ালে দুয়েকটি গরু লালন পালন করে দুধের চাহিদা মিটিয়ে একটা সময় গরু বিক্রি করে বেশ আয়ও করতে পারে। গ্রামের একজন কৃষক যদি ইচ্ছা করে তা হলে সারাদিনে কাজ করার মতো সুযোগ তার রয়েছে। জমির গড় উৎপাদন বেড়েছে। সার ও সেচের সুবিধা সরকার নিশ্চিত করেছে। উৎপাদিত ফসলের বাজারজাতকরণ করার মতো সুযোগও দেশে রয়েছে। আগের দিনের একজন কৃষক ঈদের মতো বিভিন্ন উৎসবে অর্থ বিত্তশালীদের দিকে থাকিয়ে থাকত। এখন সেই অবস্থা আর নেই। সত্যিকার অর্থে আগামী কয়েক দিন পর ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে ফিতরা দেয়ার মানুষের কিন্তু যথেষ্ট অভাব রয়েছে। মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার এমন উন্নয়ন হয়েছে যে কাউকে ফিতরা দেয়ার আগে অন্তত একবার ভাবতে হচ্ছে। অথচ ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও রমজান আসলে অস্বচ্ছল মানুষ ফিতরার জন্য আগাম বলে রাখত। এখন আর সে অবস্থা নেই। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনির অওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের জন্য ভাতা, ছাত্রী উপবৃত্তি ছাড়াও ভিজিএফ, কম মূল্যে টিসিবির পণ্য কেনার সুযোগ, ভূমিহীনদের জন্য জমির দলিলসহ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দেয়া পাকাবাড়িতে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ এখন অভুক্ত থাকার যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে না। মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার খাবার ও জীবনযাত্রার মান অনেক বেড়েছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে খাদ্যাভ্যাসে। এখন তিন বেলা নয়, দিনে বাড়তি দুই বেলা নাস্তা খাওয়ার পরও মানুষ দিনে-রাতে হরহামেশা চা নাস্তা খেয়ে কিংবা অন্যকে খাইয়ে নিজেরা যেমন তৃপ্ত হচ্ছে, অন্যকেও খুশি করতে পারছে। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই সোনার বাংলায় আমাদের কৃষক সকালের পান্তা খায় না। সে রুটি-পরোটা কিংবা গরম ভাত খেয়ে কাজে যেতে পারছে। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এই বাংলায় এখন আর কৃষক পান্তা বাসি খায় না। গরম গরম খায়।