ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গরমে নাকাল পুরো দেশ হাঁসফাঁস করছে মানুষ

* অসহ্য গরমে তীব্র যানজট, নগরজীবন দুর্বিষহ * বাতাসেও শরীর ঘামছে * তিন দিনের মধ্যে তাপমাত্রা কমতে পারে : আবহাওয়া অধিদপ্তর
গরমে নাকাল পুরো দেশ হাঁসফাঁস করছে মানুষ

দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে, যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ গরম। এই চরম গরমে নাকাল হয়ে পড়েছে সারা দেশের মানুষ। ঈদুল ফিতরের আগমুহূর্তে এমন দাবদাহে মার্কেট, বাজার ও শপিংমলে বিক্রেতা-ক্রেতা, দিনমজুর, বাসচালক, যাত্রী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ হাঁপিয়ে উঠছেন। চরম গরমে মানুষের দিনের স্বাভাবিক কাজেও ব্যাঘাত ঘটছে। তবে চলমান গরম আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে কমছে না বলে আশঙ্কা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সংস্থাটি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়েছে। তবে আগামী তিন দিনের মধ্যে তাপমাত্রা কমতে পারে।

গত কয়েক দিন ধরে তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে সারা দেশের মানুষ। তীব্র আকার ধারণ করেছে তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোকে মৃত্যুরও খবর পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।

রমজানে দাবদাহ ও দীর্ঘ যানজটে চরম ভোগান্তিতে নগরবাসী। জীবন-জীবিকার টানে ঘর থেকে বের হওয়ায় অধিকাংশ মানুষের নষ্ট হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময়। গতকাল শনিবার সরকারি ছুটির দিন থাকার পরও ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, মৎস্যভবন মোড়, পল্টন, গুলিস্তান পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশেই প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও গণপরিবহণের দীর্ঘ লাইন। একই অবস্থা আসাদগেট, পান্থপথ সিগন্যাল থেকে কারওয়ান বাজার মোড় পর্যন্ত। প্রচণ্ড গরম ও যানজটে বাসের ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়েছে।

বাড্ডা থেকে মতিঝিল নিজ কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন শরীফা নাজনিন। তিনি বলেন, যানজট না থাকলে বাসা থেকে অফিসে ৩০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছানো যায়। কিন্তু গরম ও দীর্ঘ যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার মধ্যে বসে আছি।

যানজটের কবলে পড়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন পথচারীরা। রোজা রেখে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে যেতে দেখা যায় সাধারণ মানুষকে। আর মাত্র কয়েক দিন বাকি আছে ঈদুল ফিতরের। ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর যানজট আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

রাজধানীতে পাঠাও চালান মোকারম হোসেন। তিনি বলেন, গরমে কোথাও আরাম নেই। মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে শরীরে যে বাতাস লাগছে তাও গরম। মোটরসাইকেল চালাতে গিয়েও শরীর ঘামছে। প্রচণ্ড গরমে শরীর ঘেমে লবণ-পানি বের হয়ে যাওয়ায় পানিশূন্যতা দেখা দেয়। পানিশূন্যতার কারণে প্রস্রাব করতে গেলে জ্বালাপোড়া করছে। রোজা থাকায় পানি খাওয়ার সুযোগ নেই।

গরমের সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশে বেড়েছে লোডশেডিংয়ের মাত্রা। বাড্ডা, বনশ্রী, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় লোডশেডিং দেয়া হয়েছে।

মধ্য বাড্ডার বাসিন্দা মাহবুবুল আলম বলেন, গত শনিবার দিবাগত রাতে সেহরির সময়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। তীব্র গরমে পরিবারের সবার ঘুমাতে ও সেহরি করতে কষ্ট হয়েছে। একই অবস্থা মিরপুরেও। মিরপুরের বাসিন্দা শাহনেওয়াজ বলেন, বিদ্যুৎ যাচ্ছে, তবে ঘণ্টাখানিক পর ফিরছে।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মাঠে যারা কাজ করছেন তাদের সূর্যের তীর্যক কিরণে শরীরের চামড়া পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গরম বাতাস শরীরে বিঁধছে আগুনের হলকার মতো। মানুষের পাশাপাশি গরমে গৃহপালিত পশুর হাঁসফাঁস অবস্থা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে শীত, বৃষ্টি ও গরমের আভাস আসবে এটি স্বাভাবিক। এবারও ধারাবাহিকভাবে গরম বয়ে চলছে। কিন্তু হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়েছে। তবে এবার বাতাসে আর্দ্রতা স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। তাই গরমের কারণে মানুষের কষ্ট ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সাধারণত কোনো এলাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেখানে মৃদু দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেখানে মাঝারি দাবদাহ এবং ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে তীব্র দাবদাহ চলছে বলে ধরা হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৩০ বছরের এপ্রিল মাসের বাতাসে আর্দ্রতার হিসাবে দেখা গেছে, এপ্রিলে সারা দেশে বাতাসের আর্দ্রতা ৭০ থেকে ৮২ শতাংশ পর্যন্ত ছিল। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণ কমে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে নেমেছে।

গত শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০১৪ সালে ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছিল।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দুই-একদিনের মধ্যে দেশের কিছু কিছু স্থানে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (সিলেট অঞ্চল) স্বল্প পরিসরে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। তবে আরও বড় পরিসরে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

গতকাল শনিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস তুলে ধরে আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেছেন, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। এ সময়ে সারাদেশে দিনের এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

তিনি বলেন, খুলনা বিভাগসহ ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা ও পটুয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের অবশিষ্টাংশের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।

আগামী তিন দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আবুল কালাম মল্লিক আরও বলেন, এ সময়ের শেষের দিকে দিনের তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পারে।

সারাদেশে চলমান আর্দ্রতা পরিস্থিতি উন্নতির সম্ভাবনা নেই। ফলে গরমের সঙ্গে শরীর জ্বালাপোড়া কষ্ট আগামী দুদিন থেকে যেতে পারে। এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, বছরের এ সময়ে বাতাসে আর্দ্রতা স্থানভেদে ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কম থাকে। আকাশে মেঘ সৃষ্টি ও ভেসে আসার সম্ভাবনাও কম। ফলে একদিকে তাপমাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে আর্দ্রতার কারণে মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে ঢাকা শহরের ৬৫ শতাংশ কংক্রিট বা অবকাঠামোতে আচ্ছাদিত ছিল। ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে জলাশয় ও খোলা জায়গা প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। জলাভূমি ও গাছপালা কমায় গরমের অনুভূতি প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে অনুর্ভূত হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকা শহরের ভৌগোলিক অবস্থান ভালো ছিল। এখানে চারপাশে নদী, খাল ও জলাশয় ছিল। তাপমাত্রা বেশি হলে প্রাকৃতিক উপায়ে নিয়ন্ত্রিত হতো। কিন্তু জলাভূমি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে আবাসন, কারখানা ও অফিসের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসি ব্যবহারের ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, প্রত্যেক বছর এপ্রিল মাসে বাতাসে যে পরিমাণে আর্দ্রতা থাকে তার চেয়ে এবার অনেক কম আর্দ্রতা রয়েছে। যে কারণে গরম বেশি অনুভূত হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে- দেশের ৪৯টি জেলার ওপর দিয়ে দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। জেলাগুলো হচ্ছে বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, মেহেরপুর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, বরিশাল, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, মৌলভীবাজার, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত