সমাজ সভ্যতায় সালামের অবদান

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, মানুষকে খানা খাওয়াও আর রাতের বেলা নামাজ পড়, যখন লোকেরা নিদ্রামগ্ন থাকে। বিনিময়ে শান্তির নিবাস বেহেশতে প্রবেশ করো।’ (তিরমিজি)

পবিত্র মাহে রমজানে আমাদের সমাজে হাদিসে বর্ণিত এ তিনটি আমলের চর্চা ও অনুশীলন হয় ব্যাপকভাবে।

প্রথমে রাতের বেলা নামাজ ইবাদতের কথা ধরা যাক। কর্মময় জীবনের জন্য আমাদের কাছে দিনের আলোর গুরুত্ব বেশি। যদিও ইদানিং বিদেশ ভ্রমণ কিংবা আন্তঃজেলা পরিবহণের ক্ষেত্রে দিনের চেয়ে রাতের কদর অনেক বেড়ে গেছে। ইসলামে আগাগোড়াই দিনের তুলনায় রাতের গুরুত্ব অধিক। হাদিসেও তার প্রতিধ্বনি হয়েছে। সারাদিন রোজা রেখে ইশার নামাজের পর দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে তারাবি পড়া, তারাবিতে এক খতম কোরআন পড়া ও শোনা রমজান মাসের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। শেষ রাতে পরদিনের রোজার প্রস্তুতি হিসেবে সাহরিতে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ নামাজের বাড়তি সুবিধাও অনেকে গ্রহণ করে। তাছাড়া ঘরে ঘরে কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া দরুদ ও তসবিহ পাঠ তো আছেই। রমজানের শেষ ভাগে শবেকদরের তালাশে রাতজাগা এবং মসজিদে মসজিদে ইতেকাফ সব মিলে পুরো রমজানে রাতজাগা ইবাদতের বেহেশতি পরিবেশ বিরাজ করে।

দ্বিতীয় আমলটি হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মানুষকে খানা খাওয়ানো। নবী নন্দিনী ফাতেমা (রা.)-এর ঘরে অভাব সত্ত্বেও যাচনাকারী এতিম, মিসকিন, বন্দিকে পাতের সম্পূর্ণ খাওয়ার তুলে দেয়ার বিনিময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির বিশদ বিবরণ সুরা দাহরে আছে। রমজানে মোমিন মুসলমানরা এ আমলটি ব্যাপকভাবে অনুশীলন করে। বিশেষ করে গরিব অসহায় মানুষের মাঝে ইফতার সামগ্রি ও খাদ্য বিতরণ, ঈদের দিন সকালে ফিতরা দিয়ে অভাবী মানুষের সাময়িক অভাব মোচন এবং জাকাত ও সাদকার ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। নিঃসন্দেহে কাজটি ইসলামি সমাজের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য।

হাদিসে আরেকটি কাজের কথা বলা হয়েছে, যা দৃশ্যত সহজ; তবে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তা হলো বেশি বেশি সালামের প্রচলন ঘটানো। রমজান ও ঈদের সৌন্দর্য বিকশিত হয় সালাম বিনিময়ের সংস্কৃতির মাধ্যমে। সালাম ইসলামি ঐতিহ্যের স্মারক। বিশ্বভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন।

মেহমান হয়ে বিদেশে গেছেন। নতুন দেশে কোনো লোককে চেনেন না, তাদের ভাষাও বুঝেন না। স্বাগতিক দেশের লোকেরা বুঝতে পারছেন না, আপনাকে কীভাবে বরণ করবে। কোথায় রাখবে। আপনার রুচি কী। কোন ধরনের খাবার খাবেন। কী পরিবেশ ভালোবাসেন। আপনি তখন বললেন, আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমতুল্লাহ। তখনই তারা আপনার পরিচয় পেয়ে যাবে। আপনার জন্য একটি শান্তির পরিবেশ ও পথ বেরিয়ে যাবে। তারা বুঝতে পারবে আপনি মুসলিম। আপনার পছন্দের হালাল খাবার ও থাকার পরিবেশ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা তারা পাবে। কাজেই সালাম দেশ ও কালজয়ী আন্তর্জাতিক ভাষা।

সালামের সঙ্গে যুক্ত আছে মানব জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আধুনিক সভ্যতায় মানব জাতির অতীত ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধান ও জাদুঘরের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। মিশরের পিরামিড খননের পেছনে পশ্চিমা গবেষকদের গবেষণা বিরামহীন। উদ্দেশ্য, মানব জাতি অতীতে কেমন ছিল, কি খেত, কি বলত, জীবনাচার কি রকম ছিল তার তথ্য উদ্ঘাটন। এ ক্ষেত্রে অতীতে মানব জাতির পারস্পরিক অভিবাদন রীতি কেমন ছিল, কি বলে তারা পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করত একটি সূত্রে তা আমরা সহজে জানতে পারি। সেই সূত্র হল, মুসলিম সমাজে প্রচলিত সালাম। এই ঐতিহ্য একেবারেই আধুনিক। আজকের দিনের আলোর মতোই প্রাণবন্ত।

সালামের অতীত সম্পর্কে হাদিস শরিফের একটি বর্ণনা গোটা মানব সভ্যতার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা আদমকে স্বীয় আকৃতির উপর সৃষ্টি করেন। তার দৈর্ঘ্য ছিল ষাট গজ। সৃষ্টি করার পর তাকে নির্দেশ দিলেন, তুমি গিয়ে ওই লোকদের সালাম জানাও। তারা ছিল ফেরেশতাদের একটি দল, বসা ছিল তারা। তারা তোমাকে কী অভিবাদন জানায় মনোযোগ দিয়ে শোনো। এই অভিবাদনই তোমার সম্ভাষণ ও তোমার বংশধরের সম্ভাষণ। অতপর আদম সেখানে গিয়ে বললেন, আসসালামু আলাইকুম। আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তখন তারা বলল, আসসালামু আলাইকা ওয়ারাহমাতুল্লাহ।’ তোমার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর রহমত। নবীজি বলেন, তারা আদমের চেয়ে ওয়ারাহমাতুল্লাহ (আর আল্লাহর রহমত) বাক্যটি অতিরিক্ত বলল। ...(বোখারি, মুসলিম)

মানব জাতির সৃষ্টিলগ্নের এ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মুসলামরা পরস্পর দেখা সাক্ষাতে, কথা বলতে প্রতি মুহূর্তে চর্চা করে। এ সম্ভাষণের মাধ্যমে তারা বিশ্বশান্তির চর্চা করে ধর্মীয় চেতনা ও বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে। প্রাত্যহিক ফরজ নামাজ শেষে প্রিয় নবীর প্রিয় দোয়া ছিল, আল্লাহুম্মা আন্তাস সালাম... প্রভুহে তুমি শান্তিময়, তোমার কাছ থেকেই শান্তি আসে। তুমি বরকতময় তুমি মহিয়ান। আমাদের দাখিল করাও দারুস সালাম, শান্তির নিবাস বেহেশতে।’ এই দোয়া অহরহ আমরাও করি। তদুপরি নামাজ থেকে বিদায় নেয়ার মুহূর্তে ডানদিকে ও বামদিকে মাথা ঘুরিয়ে সালাম জানাই দু’পাশের মানুষকে, পরিবেশকে। সেই সালামের প্রতিধ্বনি শান্তির বাণী চলে যায় লোকালয়ে, সমাজ সভ্যতায়, গোটা বিশ্বে।

শান্তির এ পয়গাম অর্থে বিবেচনায়ও অতুলনীয়। সালাম মনের শান্তির বাহক। উচ্চ রক্তচাপসহ অনেক রোগের উৎপত্তি হয় মনের অশান্তি ও অস্থিরতা থেকে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যদি কেউ মন খুলে সালাম দিতে পারে, তার মনে তখন পরম শান্তির সুবাতাস বয়ে যায়। যাকে সালাম দিয়েছে তার মনেও শান্তির পরশ বুলায়। কারণ, তাতে আল্লাহর কাছ থেকে বিলানো হয় শান্তি রহমত ও বরকত। বলা হয় ‘আপনার প্রতি আল্লাহর পক্ষ হতে শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।’ যিনি সালাম নিলেন তিনিও একই ভাষায়; বরং তার চেয়ে আরো সুন্দরভাবে জবাব দেন। এ কারণে মানসিক রোগী বা যারা অশান্তিতে আছে তারা অন্যকে সহজে সালাম দিতে পারে না, বা জবাব দেয়ার শক্তিও তাদের নেই।

পশ্চিমা দুনিয়ার সম্ভাষণ হ্যালো-এর ব্যবহারিক অর্থ যাই হোক। ইংরেজি হলো শব্দের অর্থ কিন্তু ভালো নয়, যা আমরা সবাই বুঝি। আদব বলা বা নমস্কারের মধ্যেও এমন ভাবার্থ নেই, সালামের সাথে যার তুলনা হতে পারে। বস্তুত বিভিন্ন জাতির অভিবাদন রীতির সঙ্গে তুলনা করলেও বুঝতে পারব, ইসলামের ছায়াতলে আমরা কতবড় সৌভাগ্যবান।