ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জনশূন্য মার্কেটে রহস্যময় আগুন

* বঙ্গবাজারের কান্না এবার নিউ সুপার মার্কেটে * কারো স্বপ্ন পুড়েছে আগুনে কারো ভিজেছে পানিতে
জনশূন্য মার্কেটে রহস্যময় আগুন

ঈদের আগে জনশূন্য মার্কেটে ভোরে আগুন লাগার ঘটনা জনমনে রহস্যের জন্ম দিয়েছে। খোদ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনও মার্কেটের আগুন নাশকতা কি না, তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঈদের আগে কেন মার্কেটে মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- ঈদের ঠিক আগে একের পর এক মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ আগুন ভোরে লাগছে। ব্যবসায়ীরা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই আগুনের ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা কি না? নাশকতা কি না?

৪ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল মাত্র ১০ দিনের ব্যবধান। এই ব্যবধানে রাজধানীর কাপড়ের অন্যতম প্রধান দুই মার্কেট প্রায় একই সময়ে একইভাবে আগুনে পুড়ল। দুই মার্কেটেই আগুন লাগার সময় মোটামুটি একই। বঙ্গবাজারে আগুন লেগেছিল ভোর ৬টা ১০ মিনিটে, আর আজ নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে।

দুই মার্কেটেই ক্ষতির চিত্রেও মিল রয়েছে। ঈদের আগে বেচাকেনার জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নেয়া ছিল ব্যবসায়ীদের। আগুন কেড়ে নিয়েছে সব। নিউ সুপার মার্কেট মূলত কাপড়ের মার্কেট। এখানে শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস, শার্ট-প্যান্ট এবং পাঞ্জাবিসহ নানা ধরনের কাপড় ছিল। এছাড়া খেলনা ও আসবাবপত্রসহ নানা ধরনের পণ্য ছিল।

এই মার্কেটের তৃতীয় তলার ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, গতকাল রাত ২টা পর্যন্ত দোকানে ছিলাম। ভোরে খবর শুনি, আগুন লেগেছে। এসে দেখি মার্কেটের তৃতীয় তলায় আগুন জ্বলছে। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তিনি আরো বলেন, আগুনে আমার দোকানের সবকিছু পুড়ে গেছে। আমার স্বপ্ন শেষ ভাই। আমি এখন কী করব? ঈদ উপক্ষ্যে ঋণ করে ১০ লাখ টাকার মাল এনেছি, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

নোঙর ফ্যাশন নামে একটি দোকানের মালিক রফিকুল ইসলাম রোকন বলেন, যা কিছু ছিল সব আগুনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখছি আমার সব সম্পদ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। কিছুই করতে পারছি না। মালামাল বের করতে পারছি না। স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে মালামাল উঠিয়েছি। এখন আমি কী জবাব দেব তাকে?

ব্যবসায়ী নূপুর বেগম বলেন, আমাদের তিনটি দোকান ছিল, এর মধ্যে একটা দোকানের অর্ধেক মাল নামিয়েছি। আর সব পুড়ে গেছে। আমার ভাই কথা বলছে না, পাগলের মতো হয়ে গেছে। আমার ভাই ফকির হয়ে গেছে। লাখ লাখ টাকার মাল সব গেছে। তিন দোকানই শেষ আমাদের।

আবু সাঈদ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, নিউ সুপার মার্কেটে আমাদের চারটি দোকান ছিল। এই চার দোকানের সব মালামাল আগুনে পুড়ে গেছে। আমরা কী করব, কোথায় যাব, কার কাছে বিচার চাইব? কিছু দিন আগে এমন অবস্থা হয়েছে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের। আয়ের উৎস দোকানের সব মালামাল পুড়ে যাওয়ার পর সেখানকার ব্যবসায়ীরাও নিঃস্ব হয়েছেন।

এদিকে নিউ সুপার মার্কেটের এই আগুনের জন্য সিটি করপোরেশনকে দায়ী করছেন মার্কেটের মালিক সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের লোক রাত ৩টার দিকে ব্রিজ ভাঙার কাজ করছিল। ব্রিজের ওখানে আমাদের কারেন্টের লাইন আছে সেটা তারা খেয়াল করেনি। ওই লাইনের ওপর বুলডোজার চালানোর সময়ই আগুনের সূত্রপাত হয়। তারা কোনো পরিকল্পনা না করে এই ব্রিজ ভাঙার কারণেই আজ এই দশা হয়েছে।

মোটামুটি ঘণ্টা চারেকের আগুনে পুড়েছে নিউ সুপার মার্কেট। তাতেই সর্বনাশ যা হওয়ার হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ব্যবসায়ীরা মার্কেটের ভেতরে ঢুকে দেখছেন সব শেষ। যে কাপড়গুলো পোড়েনি সেগুলোও নষ্ট হয়েছে পানিতে ভিজে।

দুপুরেও এই মার্কেট থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ দোকানে ঢুকে কাগজপত্র, টাকাপয়সা যা পাচ্ছেন বস্তায় ভরে বের করছেন।

আসমাউল মুত্তাকিন নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আমার দোকানে শীতের জ্যাকেট ও তুলার তৈরি গরম কাপড় রাখা ছিল। আগুনে না পুড়লেও পানির ছাটে নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তারপরও কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে সবগুলো বের করার চেষ্টা করছি। কীভাবে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠব তা বুঝতে পারছি না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা জোনের ডিসি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। আমরা খেয়াল রাখছি যেন কোনো দুষ্কৃতকারী এই জায়গায় কোনো ধরনের ঝামেলা তৈরি করতে না পারে।

এদিকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মার্কেট খোলা হবে না বলে জানিয়েছেন নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন।

তিনি বলেন, নিউমার্কেটের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। সব দোকান মালিকদের সঙ্গে নিয়ে আমরা এখানে অবস্থান করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হবে অর্থ্যাৎ সম্পূর্ণভাবে আগুন না নিভবে ততক্ষণ পর্যন্ত মার্কেট খোলা হবে না। সবার সঙ্গে বসে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এদিকে মার্কেটের আগুন নাশকতা কি না, তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেছেন, ঈদের আগে কেন মার্কেটে মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেন বিষয়টি খতিয়ে দেখে।

গতকাল শনিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক নিউ মার্কেটের ৪ নম্বর গেটের সামনে এক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন। ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন রাখেন, ঈদের ঠিক আগে একের পর এক মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ আগুন ভোরে ঘটছে। ব্যবসায়ীরা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই আগুনের ঘটনাগুলো একই সূত্রে গাঁথা কি না? নাশকতা কি না? জবাবে ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, আমি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করব এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। কেন একের পর এক মার্কেটগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, আজকের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একজন ভলান্টিয়ারসহ আমাদের ১২ জন ফায়ার ফাইটার আহত হয়েছেন। আমাদের মনোযোগ আগুন নিয়ন্ত্রণের দিকে, মানুষের জানমালের ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে।

ডিজি বলেন, উৎসুক জনতার ভিড় আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ ব্যাহত হয়। আমি আহ্বান জানাব শুধু এখানকার আগুন নয়, যে কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উৎসুক জনতা ভিড় না করে যদি ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন তবে আমাদের কাজ সহজ হবে।

তিনি জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করে। সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি নির্বাপণ হওয়া পর্যন্ত কাজ করবে ফায়ার কর্মীরা।

এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়া ১২ দমকলকর্মীসহ ১৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পাঁচ দোকান কর্মচারীকে নেয়া হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। আগুন নিয়ন্ত্রণে নিউ মার্কেট এলাকায় র‍্যাব-পুলিশের পাশাপাশি ১২ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়। যোগ দেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরাও।

প্রসঙ্গত, গতকাল শনিবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুনের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। খবর পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। একে একে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয় ফায়ারের ৩০টি ইউনিট। ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। ভবনটিকে ২০১৬ সালে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত