মৃত মা-বাবা ও আত্মীয়ের খেদমত

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

বিধর্মী পণ্ডিত মশাই সভায় দাঁড়িয়ে সুরা ফাতেহা পাঠ করে জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন রাখলেন, আমি সুরা ফাতেহা পাঠ করলাম, তাতে আপনাদের মাঝে কী প্রতিক্রিয়া হলো। নিজেই জবাব দিলেন, কিছুই না। অথচ মওলানা সাহেবরা দাবি করেন, কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সুরা ফাতেহা পড়লে নাকি কবরের ভেতর পুণ্য যাবে, মৃত লোকের আত্মা শান্তি পাবে। এমন আজগুবি ধর্মমত কী বিজ্ঞান সমর্থন করবে, যুক্তিতে ধরে? বিতর্ক সভায় হাজির আলেম তার্কিকরা উত্তর খুঁজে পায় না। মজলিসের মধ্যখান থেকে পণ্ডিত গোছের এক মুসলমান মাইকের সামনে কিছু বলার অনুমতি চাইলেন। বক্তৃতা শুরু করতেই তিনি বিধর্মী পণ্ডিতকে লক্ষ্য করে গালাগাল শুরু করলেন। পণ্ডিত মশাই ক্ষুব্ধ অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, দেখছেন, কী রকম অসভ্যতা। এবার মুসলিম পণ্ডিত বললেন, আমার মতো সামান্য মানুষের মুখের খারাপ কথায় যদি পণ্ডিত মশাইর অন্তরে ভীষণ জ্বালা সৃষ্টি হতে পারে, আল্লাহর পবিত্র কালামের তেলাওয়াত মৃত ব্যক্তির আত্মায় শান্তি কেন দিতে পারবে না। মুসলিম তার্কিকদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ওই দিনের সভা শেষ হয়ে যায়। ইসলাম বলে, মানুষ যখন মরে যায় তার কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। ইহ-পরকালের কল্যাণের জন্য কিছু করার কর্মশক্তি রহিত হয়ে যায়। তবে তিনটি কাজের সুফল মৃত ব্যক্তির জন্য জারি থাকে। ১. সদকায়ে জারিয়া, যে অনুদান বা মানবসেবার সুফল অব্যাহত থাকে। ২. অথবা এমন জ্ঞানের অবদান রেখে যাওয়া, মানুষ যার সুফল ভোগ করতে থাকে। ৩. অথবা এমন নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম)।

এই তিনটি কাজের সওয়াব বা সুফল মৃত ব্যক্তি কবরে হাশরে লাভ করে। বিশেষ করে সন্তানের দোয়ার সওয়াব মা-বাবার কবরে পৌঁছতে থাকে। আমরা কীভাবে মা-বাবার জন্য দোয়া করব, আল্লাহ পাক তার পথ, এমনকি ভাষাও শিখিয়ে দিয়েছেন কোরআন মজিদে। ‘রব্বিরহাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগীরা।’ তুমি বল, ‘প্রভুহে আমার মা-বাবা উভয়ের ওপর তুমি রহমত নাজিল কর, দয়া-মায়ায় তাদের আপ্লুত কর, যেরূপ মায়ামমতা দিয়ে তারা উভয়ে আমাদেরকে ছোটবেলায় লালন-পালন করেছেন। (সুরা বনি ইসরাইল : ২৪)।

আমরা নিজেরা যদি পিতামাতার জন্য এভাবে দোয়া করি, তাদের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা পোষণ করি, তাহলে আশা করা যায় আমাদের ছেলেমেয়েরাও আমাদের জন্য দোয়া করবে, স্মরণ করবে। দ্বিতীয়ত, সন্তানদের এমন কিছু শেখাতে হবে, যাতে তারা আমাদের জন্য দোয়া করে। তাদের দেখে অন্যরাও আমাদের জন্য দোয়া করে। বিদ্যুৎ সংযোগে এখন যেভাবে তার লাগে, আগে টেলিযোগাযোগেও তারের সংযোগ লাগত। এনালগ যুগে মফস্বল থেকে ঢাকার সঙ্গে কথা বলতে প্রাণ বেরিয়ে যেত। এখনকার মতো মুহূর্তে মোবাইলে টিপ দিয়ে দৃশ্যমান খরচপাতি ছাড়াই দুনিয়ার ওই প্রান্তের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা ছিল অকল্পনীয়। সময়ের বিবর্তনে আমরা যতই কিয়ামতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, অনেক অসম্ভব বিষয় আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হচ্ছে। সামনে হয়তো দেখা যাবে মোবাইল সেটের পরিবর্তে মনোসংযোগের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে, মনের শুভ কামনা, দুঃখ-বেদনার কথা ব্যক্ত করতে পারছে। মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়ার ব্যাপারটিও মনোসংযোগের মতো। এখানে কারো মন খুশি করলে ওখানে কবরে আপনজন খুশি হন। এই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সমানে রাখলে দুটি হাদিসের বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হবে। এক হাদিসে ইবনে উমর (রা.) তার বাবার বন্ধুকে সম্মান করছেন, অপর হাদিসে স্বয়ং নবী করিম (সা.) সহধর্মিণী আমাদের মা খাদিজাতুল কুবরার বন্ধবীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। ইবনে দীনার বর্ণনা করেন, ইবনে উমরের একটি গাধা ছিল। (গাধা তখন অন্যতম যানবাহন ছিল) তিনি যখন মক্কায় যেতেন এবং যখন উটে আরোহণ করতে বিরক্ত বোধ করতেন, তখন আরামের জন্য এ গাধার পিঠে সওয়ার হতেন এবং নিজে পাগড়িটা মাথায় বেঁধে নিতেন। চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী তিনি একদিন এ গাধার পিঠে সওয়ার ছিলেন। এমন সময় এক বেদুইন এসে ইবেন উমরকে বলে, তুমি অমুকের ছেলে অমুক না? তিনি বললেন, হ্যাঁ। ইবনে উমর (রা.) তাকে গাধাটা দিয়ে দিলেন এবং বলেন, এর পিঠে সওয়ার হও। তিনি তার পাগাড়িটাও তাকে দিয়ে বলেন, এটা তোমার মাথায় বাঁধো। অপর সঙ্গীরা তাকে বলেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। গাধাটা এ বেদুইনকে দিয়ে দিলেন, অথচ এটার ওপর আপনি সওয়ার হতেন এবং পাগড়িটাও তাকে দিলেন, অথচ এটা আপনি মাথায় বাঁধতেন। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি ঃ সৎকাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সৎকাজ হলো পিতার মৃত্যুর পর তার বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। এ ব্যক্তির পিতা উমরের বন্ধু ছিল। (মুসলিমের বরাতে রিয়াদুস সালেহীন)। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) এর স্ত্রীদের মধ্যে খাদিজার প্রতি আমার যে পরিমাণ ঈর্ষা হতো অন্য কারো প্রতি তদ্রুপ হতো না। অথচ আমি তাকে কখনো দেখিনি। কিন্তু তিনি (নবীজি) তার কথা প্রায়ই বলতেন। কখনও তিনি বকরি জবেহ করতেন, এর গোশত টুকরো টুকরো করতেন অতঃপর তা খদিজার বান্ধবীদের নিকট পাঠাতেন। আমি মাঝেমধ্যে তাঁকে বলতাম, খুব সম্ভব খাদিজা ছাড়া দুনিয়াতে আর কোনো নারী ছিল না। তিনি বলতেন, সে এরূপ ছিল এবং এরূপ ছিল। (অর্থাৎ বিভিন্নভাবে খাদিজার প্রশংসা করতেন) তার গর্ভে আমার কয়েকটি সন্তান জন্মেছিল। (বোখারি, মুসলিমের বরাতে রিয়াদুস সালেহীন, হাদিস নং ৩৪৪)। একজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, আমাদের দেশে ফাতেহা বা কুলখানিতে মৃতদের স্মরণে গরিব অভাবী ও নিকটজনদের পানাহার করানোর যে রেওয়াজ চলে আসছে, এই হাদিসে তার পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। তবে মৃত ব্যক্তিদের হক সম্পর্কে একটি স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে একটি হাদিসে। আবু উসাইদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় বনু সালামা গোত্রের এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল। পিতামাতার মৃত্যুর পরও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার দায়িত্ব আমাদের ওপর রয়েছে কি? কীভাবে তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করব। তিনি বলেন, হ্যাঁ। তুমি তাদের জন্য দোয়া করবে, তাদের গোনাহর ক্ষমা প্রার্থনা করবে, তাদের কৃত ওয়াদা পূর্ণ করবে এবং তাদের বন্ধু-বন্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। (্আবু দাউদ সূত্রে রিয়াদুস সালেহীন, হাদিস-৩৪৩)।