মুজিবনগর সরকার : জানা-অজানা

প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে মতানৈক্য ও স্থান সংকটে পেছায় ‘শপথ অনুষ্ঠান’

সোহেল সানি

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?’

উপর্যুক্ত প্রশ্নটা করেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী; বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পরিচয়দানকারী তাজউদ্দীন আহমদকে। প্রতি উত্তরে ইন্দিরা গান্ধীকে তাজউদ্দীন আহমদ ইংরেজিতে যা বলেছিলেন, তার বঙ্গানুবাদ হলো- ‘২৫ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার অদৃশ্য স্থান থেকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। শুরু হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। তার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী আমি। যেকোনো মূল্যে আমাদের বিজয়ী হতে হবে। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য দরকার। ভারতের গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা চাই।’

৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয় বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধীর কাছেই তাজউদ্দীন শুনতে পান যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। যাবতীয় সহায়তা দেয়া হবে।’ ইন্দিরা গান্ধী এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নগেন্দ্র সিংকে দায়িত্ব দেন এবং একটি ছোট বিমানও দেয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় আসেন। গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে ছিলেন এএইচএম কামরুজ্জামান ও এম মনসুর আলী। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদও অবস্থান করছিলেন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সেদিন আমাকে একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, সরকার গঠনের প্রশ্নে পরিষদ সদস্যরা খুশি নন। তারা প্রিন্সেস স্ট্রিটের এমএলএ হোস্টেলে আছেন। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বুঝতে পারলাম। কামরুজ্জামানকে নিয়ে পরিষদ সদস্যরা একটি বৈঠকও করলেন। মিজানুর রহমান চৌধুরীও দ্বন্দ্বে ছিলেন। রাতের বেলা লর্ড সিনহা রোডে বৈঠক বসল। শেখ মনি তার বক্তব্যে বললেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দি, বাংলার যুবকরা বুকের তাজা রক্ত দিচ্ছে। এখন কোনো মন্ত্রিসভা গঠন করা চলবে না। মন্ত্রী মন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময় সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে। বৈঠকে প্রায় সবাই একই সুর। তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয়দান ছিল সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা। কারণ, তাজউদ্দীন আহমদ নিজেকে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রধানমন্ত্রী পরিচয় দেন ২ এপ্রিল ও দ্বিতীয় বার ৪ এপ্রিল ১৯৭১। সরকার গঠন হয় ১০ এপ্রিল আর শপথগ্রহণ ১৭ এপ্রিল। তাহলে প্রধানমন্ত্রী হলেন কী করে? কূটনীতির কূটকৌশল থাকতে পারে। তাই হয়তো শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মনে নেতিবাচক প্রশ্নের উদ্রেক করেনি কিন্তু দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে সহচরের তোপের মুখে পড়তে হয় তাজউদ্দীন আহমদকে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত ছয় সদস্যবিশিষ্ট আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় তাকে।

যাই হোক প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। এএইচএম কামরুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাকে হাইকমান্ডের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ কথা বলে উসকে দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রাদেশিক পরিষদের নেতা হিসেবে এম মনসুর আলী হবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে প্রধানমন্ত্রী হবেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আপনি। পদপদবি নিয়ে সৃষ্ট অন্তঃকলহ উত্তাপ ছড়িয়ে দিল- ৮ এপ্রিল কলকাতার ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডের বাড়িতে। ওখানে উপস্থিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা। অধিকাংশই তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীর পদগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং পরিস্থিতি সরগরম করে তোলেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ও যুবনেতাদের পক্ষে শেখ ফজলুল হক মনি বিতর্কের অবতারণা করেন। স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপায়নের অবশ্যকীয় শর্ত ও সরকার গঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সরকার কাঠামোর প্রকৃতি নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়াটা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’- শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাণ্ডব। ফলে একেক করে আওয়ামী লীগের নেতারা সীমান্তে গিয়ে জড়ো হন। বঙ্গবন্ধু আগেই তাদের আত্মগোপনের নির্দেশ দেন। সমস্যার সৃষ্টি হয় প্রধানমন্ত্রীর পদে আগাম ঘোষণা দেয়ায়। উত্তপ্ত বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমেদের নীতিনৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর পদের মূল দাবিদার এম মনসুর আলী বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘মতভেদ থাকলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা এক। আমাদের উদার হতে হবে।’ সত্যিই মনসুর আলী তাজউদ্দীনের প্রতি সদয় হয়ে সেদিন যে উদারতা প্রদর্শন করেন, তা ছিল বিরল ঘটনা। সেদিন অস্থিরতাহীন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীশক্তি দ্বারা অসীম নৈব্যর্ত্তিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন চুয়ান্নের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য মনসুর আলী। তবে তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক আচরণ ও নৈতিকতা নিয়ে কটাক্ষ করে বলেন, ‘তিনি এটা ঠিক করেননি, তবুও বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী রূপে তাজউদ্দীন আহমেদকে মেনে নেয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই।’ বস্তুত মনসুর আলীই প্রথমে এএইচএম কামরুজ্জামানকে তাজউদ্দীনের পক্ষে সম্মত করান। এ পরিস্থিতিতে খন্দকার মোশতাক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ দাবি করেন। এতে সমস্যায় পড়েন তাজউদ্দীন আহমদ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এ দপ্তরটি নিজের হাতে রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু শেষে খন্দকার মোশতাকেই পররাষ্ট্র দপ্তর দেয়া হয়। হাইকমান্ডের সদস্য হিসেবে ড. কামাল হোসেন হতেন আইনমন্ত্রী। কিন্তু তিনি২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। ফলে আইনজীবী খন্দকার মোশতাক আইনবিষয়ক দপ্তরটিও কব্জা করেন। তারপরও খন্দকার মোশতাক কুটকৌশল প্রয়োগ থেকে বিরত ছিলেন না। নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে রাখার চাল চালেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের অসাধারণ মানসিকতার কারণে সে চাল ভেস্তে যায়। প্রধানমন্ত্রীর হাতেই রাখা হয় নির্বাহী ক্ষমতা। তাজউদ্দীন আহমদ এসবই হজম করেন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মহান দায়িত্ববোধ থেকে। আর কামরুজ্জামান ছিলেন প্রাণখোলা সরল মানুষ। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে তিনি আর দ্বিধা ছিল না।

যাহোক ১০ এপ্রিল বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদ লর্ড সিনহা রোড থেকে সোজা বিমানবন্দর চলে যান আগরতলায় যাওয়ার জন্য। ১০ এপ্রিলই তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ সম্প্রচারিত হলো ভারত রেডিও থেকে। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের কণ্ঠে বলা হলো- এখন ভাষণদান করবেন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।

গোলক মজুমদারকে ১০ এপ্রিল এ ভাষণ সম্প্রচার করতে মানা করলেও তা প্রচার হয়ে যায়। সারাবিশ্ব জেনে গেল সরকার গঠনের খবর। তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের পর রাতে কর্নেল নুরুজ্জামান ও আব্দুর রউফ আসেন। খুঁজে পাওয়া গেল সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নানকে। ওখান থেকে আগরতলা। উপরাষ্ট্রপতি অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যিনি বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম ডা. আলীম চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। সেই বাসা হতে পরচুলা ও মেয়েদের শাড়ি পরে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। কর্নেল ওসমানীও আগরতলায়।

পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক

তাজউদ্দীন আহমদ ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে ধানমন্ডির নিজের বাড়িতে চলে যান। ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে বেরিয়ে তাজউদ্দীনের বাড়িতে হাজির হন। এ সময় শুরু হয়ে যায় ঢাকায় গণহত্যার তাণ্ডবলীলা। ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন তাজউদ্দীন। পথিমধ্যে ড. কামাল নেমে পড়েন। পরবর্তীতে জানা যায় ড. কামাল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীরকে নিয়ে মেহেরপুর কুষ্টিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতীয় বিএসএফ ফাঁড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

জাতীয় পরিষদের সংসদীয় দলের নেতা ছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেই হিসেবে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ‘ভাবি প্রধানমন্ত্রী’ বলে সম্বোধনও করেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর মুখে ২৬ মার্চ গ্রেপ্তারকালে বঙ্গবন্ধু এক বার্তায় বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন’। এর পরিপ্রক্ষিতে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ।

স্বভাবতই পাকিস্তানের সরকার কাঠামোর পরিবর্তে বাংলাদেশের সরকার কাঠামোর ভিন্নচিন্তা আসে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের মাথায়।

আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির হুইপ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের ভাষায়, এরই মধ্যে আমরা লক্ষ্য করলাম, ‘বঙ্গবন্ধু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। সারা দেশের মানুষের ভালোবাসা তাকে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথাই যেন বাঙালির প্রাণের কথা। বঙ্গবন্ধুর মনের কথা যেন তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন। ইঙ্গিতই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ মুষ্টিবদ্ধ হাত মুখে রেখে বঙ্গবন্ধুর কথা কান পেতে শুনতেন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম স্মৃতিচারণ করে বলেন- ‘৭ মার্চ অপরাহ্নে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসে তার ভাষণ শুনে বিস্মিত হয়ে গেলাম। ভাষণের প্রতিটি শব্দ, ভাষা ও ভঙ্গির মধ্যে তিনি একটি ইতিহাস আবৃত্তি করলেন। আবেগময়ী সেই ভাষণে বাঙালি জাতিকে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির বাণী শোনালেন। সেই ভাষণ ছিল একদিকে জ্বালাময়ী অন্যদিকে নির্ভুল যুক্তি ও গভীর আত্মপ্রত্যয়ী। এখন দেশবাসীর দায়িত্ব হলো হানাদার বাহিনীকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করা।’

অন্যদিকে ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের ভাষায় তাজউদ্দীন আহমদ নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেম ও মুজিবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। বেশি কাজ করেও কৃতিত্বের দাবি করতেন না। আমি যখন বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রস্তাব করি, তখন তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বুঝবেন না। ঠিক করলেন তাজউদ্দীন আহমদ নিজেই- দেশের নাম হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। একটি মনোগ্রাম চারপাশে গোলাকৃতি লাল এর মাঝখানে সোনালি রঙের মানচিত্র। রেহমান সোবহান ও ড. আনিসুর রহমান এলেন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কথা বললেন রেহমান সোবহান। তিনি তাজউদ্দীনের ভাষণে এই কথাটি লিখলেন চধশরংঃধহ রং ফবধফ ধহফ নঁৎৎরবফ ঁহফবৎ সড়ঁহঃধরহ ড়ভ ঈড়ৎঢ়ংবং (পর্বত প্রমাণ লাশের নিচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে) এর সঙ্গে আমীর উল ইসলাম যোগ করেন, ‘আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছেলেদের রক্ত ও ঘামে মিশে জন্ম নিচ্ছে নতুন বাংলাদেশের।’

১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। ওই নির্দেশের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার জন্মদিনে সকালেই আওয়ামী লীগের সভা ডাকেন। বৈঠকে সবাই মত দেন যে সশস্ত্র পন্থায়ই পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা করতে হবে। বৈদেশিক সাহায্য সমর্থন নিয়েও আলোচনা হয় সভায়। তাজউদ্দীন আহমদ বক্তৃতায় বলেন, ‘আমাদের সংগ্রামকে গণনভিত্তিক সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত করতে হবে। সবশেষে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য সবাইকে প্রস্তুতিগ্রহণের নির্দেশ দেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সারা দেশে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ বাংলাদেশের সর্বত্র উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ওদিন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের হাতে বৈঠককালে বঙ্গবন্ধু একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। ইয়াহিয়া খান বলেন- পরবর্তী বৈঠকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। কিন্তু ২৪ মার্চও তিনি নীরব থাকেন। উল্টো সামরিক বাহিনীর লোকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের দাবি, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে ‘সোয়াত জাহাজে’ করে অস্ত্র আসছে। বঙ্গবন্ধু হাজী গোলাম মোর্শেদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার কাছে একটি নির্দেশ পাঠান।

২৪ মার্চ এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সবাকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু বাসভবনের পেছনে গিয়ে ১ মিনিট করে উপস্থিত সব নেতার সঙ্গে কথা বলেন। বিকাল থেকেই বাসভবনে থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। বিকাল থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ, অন্যতম হুইপ আব্দুল মান্নান, আমিসহ নেতাদের প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনের জন্য চাপ দিই। কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আমার আত্মগোপন সম্ভব নয়, আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’ ২৫ মার্চ বিকালে পুনরায় তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও আমি আত্মগোপনের প্রশ্ন তুলি। বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে ৮টায় সাংবাদিকদের কাছে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের দাবি রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আবারো হাজির হন ড. কামাল হোসেন ও তিনি। বঙ্গবন্ধুকে তারা আবার আত্মগোপনের কথা বললে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোমরা ওয়াদা করেছ, আমি যা নির্দেশ করব তাই শুনবে। এই মুহূর্তে আমার বাসভবন ছেড়ে তোমরা চলে যাও। শহরের সব খবর আমার কাছে আছে। ইয়াহিয়া ঢাকা ছাড়ার পরপরই আক্রমণ শুরু হবে। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে ঢাকার সকল লোককে ওরা হত্যা করবে। আমার জন্য আমার জনগণের জীবন যাক, এটা আমি চাই না। ব্যারিস্টার আমীর বলেন, আমি এবং ড. কামাল বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে যাই। শয়ন কক্ষ থেকে লুঙ্গি ও গায়ে পাঞ্জাবি পরিহিত তাজউদ্দীন আহমদ কাঁধে একটি ব্যাগ ও ঘাড়ে একটি রাইফেল ঝুলিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পথিমধ্যে ধানমন্ডির ১৫ নম্বর সড়কের কাছাকাছি ড. কামাল হোসেন নেমে গেলেন। তাজউদ্দীন আহমদ লালমাটিয়ার রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল গফুরের বাসায় গেলেন। গফুরের বাড়ির অসম্পূর্ণ ছাদের ইট-সুরকীর ওপর বসে পাকিস্তানি সেনাদের হামলার মুখে ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার শুনছিলাম। মধ্য রাতে ব্রাশফায়ার ও বিকট শব্দ শুনে তাজউদ্দীন আহমদ কেঁদে উঠলেন। তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘এবার দস্যুরা হয়তো ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ করছে। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিষোদগার করেন। নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ৯৭ ভাগ ভোট পাওয়া আওয়ামী লীগকে। সুতীব্র ক্রোধ বেরিয়ে আসে ইয়াহিয়ার ভাষণে।

২৫ মার্চের গণহত্যার খবর ভারত বা বিশ্বের কোনো গণমাধ্যমে প্রচার না হলেও ২৬ মার্চের রাতে অস্ট্রেলয়া বেতার এ হত্যার খবর প্রচার করে। যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ (পরে প্রত্যেকে মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক) প্রমুখ নদী পার হয়ে জিনজিরায় চলে যান। শেখ কামাল ও শেখ জামাল বাড়ি থেকে আগেই বেরিয়ে পড়েছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে নিয়ে নদী পার হয়ে নবাবগঞ্জে যান। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সুবেদ আলী টিপুর বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ওখান থেকে চলে যাই প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আশরাফ চৌধুরীর বাড়িতে। পদ্মার তীরে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। উদ্দেশ্য ফরিদপুরে পৌঁছা। তারপর প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ইমাম উদ্দিনের বাড়িতে। তাজউদ্দীন সেখানে বসে রাজবাড়ীর মহকুমা প্রশাসক শাহ ফরিদের কাছ থেকে শুনতে পান কিছু খবর। শাহ ফরিদ চুয়াডাঙ্গায় যোগাযোগ করলে জানতে পারেন যে, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তওফিক এলাহী চৌধুরী চুয়াডাঙ্গার পুলিশ ও বিডিআরের সঙ্গে যোগোযোগ করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়ার জনগণ পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু শাহ ফরিদ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। অনেক রাতে তাজউদ্দীন আহমদ মাগুরায় গিয়ে দেখলেন মহকুমা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরি করে ফেলেছেন। সেখানে সোহরাব হোসেন এমএনএ সংগ্রাম করছেন। সেখান থেকে সোহরাব হোসেন তাজউদ্দীন আমাকে নিয়ে জিপে করে ঝিনাইদহ পৌঁছেন। আমরা আব্দুল আজিজের বাসায় গিয়ে উঠি। সেখানে বসে এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদকে খবর পাঠানো হয়। যশোর সেনানিবাস জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা অবরোধ করে রেখেছে। চুয়াডাঙ্গা মহকুমা প্রশাসক অবাঙালি হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়। কুষ্টিয়ার অবাঙালি মহকুমা প্রশাসকও বন্দি। মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গায় নেতৃত্ব করেন। বেলা ৩টার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ সীমান্তের পথে রওয়ানা হন। তাওফিক এলাহি, মাহবুব উদ্দিন ও আমি তার সঙ্গে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভারতে যাওয়ার। ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো

বেলা ৩টার দিকে। সীমান্তের পথে রওয়ানা হলাম। এর আগে আমরা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. আসহাবুল হক ও মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহি, মেজর ওসমান ও পুলিশের মাহবুব উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে চুয়াডাঙ্গায় বৈঠক করি। সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মধ্যে খালের ওপর একটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন আহমদ বসে থাকলেন। প্রতিনিধি হিসেবে ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে পাঠালেন তৌফিক এলাহি ও মাহবুব উদ্দিনকে। কিছুক্ষণ পর একজন ভারতীয় সামরিক অফিসার জানালেন আপনাদের আগমনের খবর ইতিমধ্যে কলকাতায় পৌঁছে গেছে। রাত ৮টার দিকে বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদকে জানান, তাদের হাইকমান্ডের নির্দেশেই তিনি এসেছেন।

তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তির সংগ্রামে ভারতের সর্বাত্মক সাহায্যের আবেদন জানালে গোলক মজুমদার বলেন, ‘কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীজী এ বিষয়ে বলবেন। দিল্লির সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়।’ তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে আশ্বস্ত করেন যে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবেন। মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে যান। সেখানে বিএসএফের প্রধান ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নিরাপত্তা প্রধান রুস্তমজীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় তাজউদ্দীন আহমদকে। এরপর ‘আসাম হাউজ’ নামে একটি বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। রুস্তমজী অতিরিক্ত কোনো পোশাক-আশাক না দেখে তার পায়জামা ও কোর্তা দিলেন। ছয় ফুট লম্বা বিএসএফ প্রধানের কোর্তা তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সামাল দেয়া কষ্টকর হলো। বিএসএফের বিভিন্ন প্রধানরা গভীর রাতে জড়ো হলে বাড়িটিতে। আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদসহ ছাত্র ও যুবনেতাদের তালিকা তৈরি করা হলো। যোগাযোগের জন্য বিএসএফ দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাজউদ্দীন আহমদ তাদের জানান এরই মধ্যে যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ, কুষ্টিয়া সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, চুয়াডাঙ্গা শক্তঘাঁটি হয়ে উঠেছে। যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসম্ভব সাহায্য দিতে বিএসএফ রাজী হলো। পরের দিন সকালে বিএসএফ নিজস্ব রেডিও’র মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও গণহত্যার কথা প্রচার করা হয়। প্রথমে চুয়াডাঙ্গাকে বিপ্লবী সরকারের রাজধানী করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলে মেজর ওসমানের সঙ্গে তার তেজস্বী স্ত্রীও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৬ নভেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বেগম ওসমান নিহত হন।

১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তাজউদ্দীন আহমদ। সঙ্গে বিএসএফ প্রধান গোলক মজুমদার। সরজিৎ চট্টোপাধ্যায় পরিধেয় কাপড়চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্যুটকেসের ভেতর নিয়ে আসেন। ওখান থেকে রাত ১০টার দিকে জিপে করে একটি মিলিটারি মালবাহী বিমানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাজউদ্দীনকে। এই মালবাহী বিমানে নেয়ার কারণ ছিল বিষয়টি গোপন রাখা। ভোরে পৌঁছার পর প্রতিরক্ষা কলোনির একটি বাড়িতে রাখা হলো। রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, এমআর সিদ্দিকী, সিরাজুল হক বাচ্চু মিয়া ও ছাত্রলীগের এককালীন সভাপতি আব্দুর রউফ তখন দিল্লিতেই অবস্থান করছিলেন।

এদিকে চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ও ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা-সংক্রান্ত বার্তা প্রচারের কথা জানতে পারেন তাজউদ্দীন আহমদ। এমআর সিদ্দিকী আগরতলা ও আবদুর রউফকে রংপুর পাঠিয়ে দেন তাজউদ্দীন। ময়মনসিংহ থেকে রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ও সৈয়দ সুলতান চিঠি হস্তগত হয় তাজউদ্দীনের।

এদিকে খন্দকার মোশতাককে ঢাকা থেকে নিয়ে যান ড. টি হোসেন। সিলেট থেকে আব্দুস সামাদ আজাদ ও চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমেদ চৌধুরীও সেখানে গিয়ে পৌঁছেন। তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুবুল হক চাষী আগেই হাজির হন। আগরতলার সার্কিট হাউজে বসে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হতে অনুরোধ করা হয়।

খন্দকার মোশতাক খুবই মন খারাপ করেছিলেন। তিনি বলছিলেন, তাকে যেন মক্কা পাঠিয়ে দেয়া হয়। টি হোসেনের ভাষ্য মতে খন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মোশতাক বলল, তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। মোশতাক রাজি হওয়ায় জহুর আহমেদ চৌধুরী মোনাজাত করেছিলেন বলে জানালেন ব্যারিস্টার আমীর। ১৩ এপ্রিল কলকাতা ফিরে গেলেন সবাই। আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয় চুয়াডাঙ্গায়। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী দখল করে নেয়ায় সে চিন্তা বাদ দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলাকে শপথগ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করালেন। কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী সুব্রত রায় চৌধুরী ঘোষণাপত্রটি দেখে দেন। বিএসএফ ওসমানীর সামরিক পোশাক তৈরি করে দিল। সাংবাদিকদের জড়ো করার দায়িত্ব ছিল টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল কলকাতা প্রেসক্লাবে গেলেন। ১৭ এপ্রিল সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক, মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান ও ওসমানী একটি গাড়িতে রওয়া হলেন। আম্রকাননে পৌঁছাতে ১১টা বেজে গেল। মাহবুব উদ্দিন ও তৌফিক এলাহি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করলেন। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলি স্বাধীনতার সনদ (ঘোষণাপত্র) পাঠ করেন। কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে শপথ অনুষ্ঠানের শুরু। ছোট মঞ্চে আব্দুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথবাক্য পাঠ করান। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক ও কামরুজ্জামানকে মন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন। তাজউদ্দীন আহমদ স্থানটির নাম ‘মুজিব নগর’ নামকরণ করেন। মন্ত্রীর মর্যাদায় মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে এমএজি ওসমানী বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব বন্টন করেন। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে মুজিব বাহিনীর (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফের। তাদের অধিনায়কত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন সহঅধিনায়ক হন।

উল্লেখ্য, ইয়াহিয়ার অধীনে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ ডিসেম্বর সব প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করেই ঘনিয়ে আসে মহাবিপর্যয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ শুধু পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদেই নয়, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের কারণ।

নির্বাচনি ফলাফল অনুযায়ী জাতীয় পরিষদে বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনার জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন।

বৈঠকে ভুট্টোর একটি চমকপ্রদ উক্তি ‘ডোন্ট ফরগেট শেখ মুজিব, দ্যাট আই গট লারজেক্ট নাম্বার অব ভোটস ইন দি ক্যান্টনমেন্ট’। সামরিকজান্তা ইয়াহিয়ার গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়ে ভুট্টো কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা সবাই বুঝতে সক্ষম হন। ৩১ জানুয়ারি ভুট্টো সদলবলে ঢাকা থেকে করাচি উড়াল দেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র।

পূর্বাণী হোটেলে বঙ্গবন্ধু যখন অনুমোদিত শাসনতন্ত্রের খুঁটিনাটি নিয়ে বৈঠকরত তখনই ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। মূহূর্তে ছাত্র-জনতার ঢলে ঢাকার রাস্তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো, ‘৬ দফা না এক দফা- এক দফা, এক দফা’ স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পল্টনে বিরাট জনসভায় জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন ঊনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ, ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব ও জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন।

২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে পূর্ণ হরতাল পালনের আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ২ মার্চ ছাত্রলীগ আয়োজিত জনসমুদ্রে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব। পরের দিন ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় ছাত্রলীগের আয়োজিত জনসমাবেশ থেকে সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বরের বাসভবনটি ছিল সংগ্রামের সুতিকাগার। যে বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের মুহূর্তে ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তারবার্তার মাধ্যমে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শুরু হয় নয় মাসব্যাপী মরণপর মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় মিত্র বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় পাকিস্তানি বাহিনী। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যৌথবাহিনীর কমান্ডার জগৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে ৯৫ হাজার পাকিস্তানি সদস্যের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। পৃথিবীর বুকে অভ্যুদয় ঘটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাসবেত্তা।